Norway: নির্বাচনে বিপুল আসনে জয়ী মধ্য-বাম জোট, উল্লেখযোগ্য শক্তি বৃদ্ধি কমিউনিস্ট পার্টির

নরওয়ের বর্তমানে সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি আক্ষরিক ভাবেই ‘লাল পার্টি’ (Rødt) নামে পরিচিত। ২০১৭ সালের নির্বাচনে ১টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে ৮টি আসনে জয়ী হয়েছে তারা।
Norway: নির্বাচনে বিপুল আসনে জয়ী মধ্য-বাম জোট, উল্লেখযোগ্য শক্তি বৃদ্ধি কমিউনিস্ট পার্টির
ফাইল চিত্র - সংগৃহীত
Published on

বিভিন্ন নির্বাচন পূর্ববর্তী সমীক্ষার ভিত্তিতে আশা ছিলই, ১৩ই সেপ্টেম্বর ভোট গণনা প্রক্রিয়া অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আশা রূপান্তরিত হল বাস্তবে। নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে পূর্ববর্তী দুই নির্বাচনে পরাজয়ের পর, ২৬.৪% ভোট ও ৪৮টি আসন সহ নরওয়েতে আবার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চলেছে মধ্য-বাম সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট ‘শ্রমিক দল’ (Arbeiderpartiet)। একক ভাবে অবশ্য কোন সরকার গড়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৮৫ স্পর্শ করতে তাঁদের সাহায্য নিতে হবে তাঁদের দুই জোটসঙ্গী ‘সমাজতন্ত্রী বাম দল’ (Sosialistisk Venstreparti)‘মধ্যপন্থী দল’ (Senterpartiet)-এর।

শ্রমিক দলের এই প্রত্যাবর্তন কতটা আশার বিষয়, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ বর্তমান। এই সন্দেহ নিয়ে আলোচনার পূর্বে শ্রমিক দলের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রদান প্রয়োজন। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় নরওয়েতে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ইতিহাস কিছু পৃথক। রুশ বিপ্লবের পর ইউরোপের প্রায় সব দেশেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিপ্লবী অংশ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথক কমিউনিস্ট দল গঠন করে। নরওয়েতে তা হয়নি। বরং মার্টিন ট্রামেলের নেতৃত্বে শ্রমিক দল কমিনটার্নে যোগদান করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের রাজনীতিতে ট্রামেল কোন কোন ক্ষেত্রে লেনিনের থেকেও র‍্যাডিক্যাল নেতা হিসেবে একদা খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু ১৯১৮ থেকে ১৯২৩ কমিনটার্নের অন্তর্ভুক্ত থাকার পর, ভ্যানগার্ড তত্ত্বের প্রশ্নে ট্রামেলের শ্রমিক দল তৃতীয় আন্তর্জাতিক থেকে বেরিয়ে আসে, যদিও এই সময় নবগঠিত নরওয়ের কমিউনিস্ট পার্টি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভালোই ছিল।

বিংশ শতকের সম্পূর্ণ দুইয়ের দশক ও তিনের দশকের সূচনালগ্ন শ্রমিক দল ব্যয় করে তীব্র শ্রেণী সংঘাতে। কিন্তু স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বাকি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের মতো শ্রমিক দলও শেষপর্যন্ত নরওয়ের বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য হয়। এই তীব্র এক দশক ব্যাপী শ্রেণী সংঘাত ও তার পরবর্তী রণক্লান্ত দুই শ্রেণীর শ্রেণী সমঝোতা থেকেই নরওয়ের বিখ্যাত কল্যাণ রাষ্ট্রর (Welfare State) উদ্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুইন্সলিং-এর নাৎসি সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম নরওয়েতে শ্রমিক দলের জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি করে। কিন্তু এই সময় থেকেই তার দক্ষিণপন্থী প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁদের পুরনো উষ্ণ সম্পর্ক শীতল ও সংঘাতমূলক আকার নেয়। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে NATO-তে নরওয়ে যোগদান করে শ্রমিক দলের নেতৃত্বেই।

যদিও এই মার্কিনপন্থী বিদেশনীতির পাশাপাশি, ১৯৪৫ থেকে ১৯৬১, যতদিন জাতীয় পার্লামেন্টে শ্রমিক দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বর্তমান ছিল, তাঁরা কল্যাণ রাষ্ট্রের পরিধি ও তার দায়িত্ব ক্রমে বৃদ্ধি করেছিলেন এবং দক্ষিণপন্থীদের এই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার সকল প্রচেষ্টার প্রতিরোধ করেছিলেন, এও ঐতিহাসিক সত্য। আশির দশক থেকে অবশ্য সমাজতন্ত্র অনুপ্রাণিত জনকল্যাণ-এর আদর্শের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা থেকেও শ্রমিক দল তাঁদের দূরত্ব বাড়াতে থাকে। নব্বই-এর দশকে নতুন নয়া-উদারনৈতিক রাজনীতিকে তাঁরা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, যে বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তাঁদের পার্টির নেতা ও কর্মীরাই দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, তাকেই বেসরকারী করতে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, তাঁদের এই মতাদর্শিক দেউলিয়াপনা ও নৈতিক পতন দক্ষিণপন্থীদের সামনে বিপুল পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

২০১৩ থেকে ২০২১ রক্ষণশীল দল (Høyre) এই ছিদ্রপথে শনি হিসেবে প্রবেশ করেই নরওয়ে শাসন করতে সক্ষম হয়। ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে থেকেও শ্রমিক দল তেমন কিছু শিক্ষা নিয়েছে কিনা তা নিয়ে একান্তই সন্দেহের অবকাশ আছে। তাঁদের বর্তমান নেতা জোনাস গাহর স্তোরে নিজে ধনকুবের ও পূর্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বর্তমানে নিজের র‍্যাডিক্যাল বামপন্থী ভাবমূর্তি ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে ‘Klassekampen’ (‘Class Struggle’, নরওয়ের ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালিত সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা) হাতে সহাস্য ছবি দিলেও তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা বিশেষ বদলেছে, এমন কোন আভাস এখনও অবধি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে সরকার তিনি গড়বেন তাতে তাঁর পছন্দের শরিক যে ‘মধ্যপন্থী দল’ (Senterpartiet) তা তিনি বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

তাহলে এই নির্বাচন থেকে বামপন্থীদের আশার কি বিষয় আছে ? আশার বিষয় অনেকগুলি। একটি হল রক্ষণশীল দল (Høyre) ও তাদের জোটের যে চুড়ান্ত রক্ষণশীল ও খোলাখুলি নয়াউদারনৈতিক নীতি, যা দেশের নয়া-ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে সযত্নে লালন করছিল, আশা রাখা যায় তার একটি ইতি টানা যাবে। জোনাস স্তোরের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত যাই হোক, এইবারের নির্বাচনের অন্যতম অ্যাজেন্ডা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং কল্যাণ রাষ্ট্রকে রক্ষা। এই তিনটি সমস্যার সমাধানের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি ক্ষমতায় আসছেন। এই বিষয়গুলি তাই একেবারে এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।

এর পাশাপাশি তাঁর জোট সরকারে ‘সমাজতন্ত্রী বাম দল’ (Sosialistisk Venstreparti)-এর উপস্থিতি ও এই নির্বাচনের তাঁদের শক্তিবৃদ্ধি (তাঁরা ৭.৫% ভোট ও ১৩টি আসন পেয়েছেন) তাঁর নয়া-উদারনৈতিক প্রবণতাকে অনেকটাই সীমিত রাখবে এই ধারণা করা যায়। এর পাশাপাশি নরওয়ের অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন নরওয়েজিয়ান কনফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নও আর অন্ধ ভাবে ‘শ্রমিক দল’-কে যে আর সমর্থন করবে না, তা তারা পূর্বেই বুঝিয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট ‘লাল দল’ (Rødt), যাকে ‘শ্রমিক দল’ কুষ্ঠ রোগগ্রস্থ রুগির মতো দূরে রাখে, তাদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান হৃদ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জোনাস স্তোরেকে যদি শ্রমিক সংগঠনগুলির সমর্থন বজায় রাখতে হয়, তাহলে তিনি সহজে কনফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়নকে চটাবেন না।

নরওয়ের এই সাম্প্রতিক নির্বাচনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গে আসা যাক। নরওয়ের বর্তমানে সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি আক্ষরিক ভাবেই ‘লাল পার্টি’ (Rødt) নামে পরিচিত। এই পার্টিটি গঠিত হয়েছিল পূর্বতন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ও মাও জেদং চিন্তাধারার অনুসারী কতগুলি সাম্যবাদী দলের একত্রীকরণের মধ্যে দিয়ে। বর্তমানে দলটির মধ্যে বিবিধ প্রবণতা বর্তমান (এমনকি ট্রটস্কিপন্থীদেরও উপস্থিতি রয়েছে), যদিও নেতৃত্ব মূলতঃ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারারই অনুসারী। এই দলটি তার প্রথম নির্বাচনী সাফল্য লাভ করে ২০১৭ সালে। তারা এই নির্বাচনে একটি আসন লাভ করে। দীর্ঘ দুই দশকেরও অধিক সময়ের পর কোন কমিউনিস্ট নরওয়ের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়। এই একটি আসন এই নির্বাচনে আটটি আসনে পরিণত হয়েছে। ‘লাল পার্টি’ জাতীয় স্তরে তার প্রাপ্ত ভোট দ্বিগুণ করে ৪.৭% করেছে। তাঁদের দলীয় নীতি অনুসারে ‘লাল পার্টি’ কোনপ্রকার জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণ করবে না তা ঘোষিতই ছিল। তাঁরা অবশ্য এই আশ্বাস দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার বিলগুলিতে তাঁরা সমর্থন প্রদান করবেন। সুতরাং সামগ্রিক মূল্যায়ন করলে এই কথা বলা যায়, নরওয়ের নির্বাচন ইঙ্গিত করে ইউরোপীয় রাজনীতির ভাষ্য বামদিকে ক্রমশ সরছে।

কিছুদিন পূর্বে অবধি রাজনৈতিক ডাইনোসর হিসেবে পরিচিত কমিউনিস্টরা শক্তিবৃদ্ধি করছে বিভিন্ন দেশে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলগুলিও তাদের টোনি ব্লেয়ারের ‘নিউ লেবার’ মার্কা নিও-লিবেরালিজমের সঙ্গে চুড়ান্ত আপোষের জায়গা থেকে অনিচ্ছা করেও শ্রমিক ভোটারদের চাপে কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক প্রচেষ্টা করেও দক্ষিণপন্থীরা অভিবাসন ইস্যুতে নির্বাচন করতে সক্ষম হয়নি। শেষ অবধি নির্বাচন হয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বিষয়গুলিকে সামনে রেখেই। বর্তমানে ইউরোপ সহ সমগ্র বিশ্বে অতি-দক্ষিণপন্থা ও নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ে এমন ঘটনা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in