দীর্ঘ ১২ বছর পর দেশের স্টিয়ারিং ঘুরল বাঁ দিকে। হন্ডুরাসে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করল বামপন্থীরা। মধ্য আমেরিকার এই দেশে শেষ ২০০৯ সালে বামপন্থীরা ক্ষমতায় ছিলেন। ২০০৯ সালে বামপন্থী প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলায়া মার্কিন সমর্থিত ক্যু-তে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর থেকে মার্কিন সমর্থিত অতি-দক্ষিণপন্থী ‘হন্ডুরাসের জাতীয় দল’ (Partido Nacional de Honduras) হন্ডুরাস একচেটিয়া ভাবে শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিল।
এই বারো বছরে নব্য উদারনীতির আগ্রাসন হন্ডুরাসে স্পর্শ করেছিল নতুন সীমা। আদিবাসী অধ্যুষিত সংরক্ষিত এলাকার উপর নেমে এসেছিল ব্যাপক আগ্রাসন, দেশের অর্থনীতির রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রকে মার্কিন কোম্পানিসমূহের সুবিধার জন্য ফোঁপরা করে দেওয়া হয়েছিল, বাম আমলের একের পর এক পরিবেশ সংক্রান্ত রেগুলেশন নির্বিচারে লঙ্ঘন করেছিল জাতীয় দলের সরকার। বলাই বাহুল্য, শাসকদলের দুর্নীতি ছিল সর্বব্যাপী। এই শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ একদশক লড়াই করে গেছে বামপন্থী ‘স্বাধীনতা ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা দল’ (Libertad y Refundación) যা জনগণের কাছে ‘Libre’ বা ‘স্বাধীনতা’ নামেই অধিক পরিচিত। এর আগের প্রত্যেকটি নির্বাচনেই শাসকদলের তরফ থেকে ব্যাপক হিংসা লক্ষ্য করা গেছে। ভোটার কারচুপিও হয়েছে ব্যাপক ভাবে। তাও হতোদ্যম না হয়ে লিব্রে চালিয়ে গেছিল দক্ষিণপন্থী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম।
নির্বাচনের পূর্বে লিব্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার করে বাজিমাত করতে চেয়েছিল জাতীয় পার্টি। লিব্রে অন্যান্য ল্যাটিন আমেরিকার বামদলের মতোই ‘সাও পাওলো ফোরাম’-এর সদস্য, যার অন্যতম নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হল কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি। সেই সূত্র ধরে তাদের কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির দালাল রূপে প্রচার করেছিল জাতীয় পার্টি। এই সর্বব্যাপী প্রচেষ্টায় ‘লিব্রে’-র প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নামও বাদ দেয়নি তারা।
এইবার লিব্রে-র পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদের দাবীদার ছিলেন শিওমারা কাস্ত্রো। তাঁর পদবিকে হাতিয়ার করেই জাতীয় পার্টি ব্যাপক প্রচার চালায়। এছাড়া প্রচার চালানো হয় ধর্মকে হাতিয়ার করেও। গর্ভপাতের অধিকার অত্যন্ত ধার্মিক ক্যাথোলিক এই দেশে ভীষণ বিভাজক একটি বিষয়। লিব্রে-র এই বিষয়ে উদার অবস্থানকে আক্রমণ করেও দেশের জনতার ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল অংশের ভোট একত্রিত করতে চেয়েছিল জাতীয় দল। কিন্তু ফলাফলেই প্রমাণ, তা বিশেষ ফলপ্রসু হয়নি।
এখনও অবধি গণনার ফলাফল অনুসারে শিওমারা পেয়েছেন ৫৩.২৬% ভোট। অপরদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির নাস্রি আস্ফুরার প্রাপ্ত ভোট ৩৪.১৮%। ভোট গণনা এখনও বাকি থাকলেও জাতীয় পার্টি তার হার স্বীকার করে নেওয়ায় প্রথম মহিলা হিসেব শিওমারার শপথ শুধু সময়ের অপেক্ষা। শিওমারা কাস্ত্রো শেষ বাম প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল জেলেয়ার স্ত্রী। স্বামীর মার্কিন সমর্থিত ক্যু-তে অপসারিত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে হয়ে চলা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। দলের মহিলা সংগঠনের প্রধান হিসেবেও পূর্বে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু এইবারের বিজয় ঠিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল ইস্যুভিত্তিক। দুইপ্রকার ভোটার গোষ্ঠীর ভোট লিব্রে পেয়েছে। একটি হল গোষ্ঠী কট্টর লিব্রে সমর্থকদের ভোট যারা লিব্রের আদর্শে ও বিকল্প হন্ডুরাসে আস্থা রাখে এবং অপরটি হল জাতীয় পার্টি বিরোধী নাগরিকদের ভোট, যাঁরা লিব্রে-র থেকে বিশাল প্রত্যাশা রাখেন না বা তার বাম রাজনৈতিক মডেলেও আস্থাশীল নন, কিন্তু জাতীয় দলের বিদায় দেখতে আগ্রহী। বহু অ-বাম ভোটারও অতি-দক্ষিণ জাতীয়দলের গত এক দশকের কাজকর্মের ফলে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে ওয়াকিবহালদের মতে সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে এইবারের নির্বাচনে। তাই চিরাচরিত বামপন্থী ভোটারদের বাইরেও উদারপন্থী, এমনকি মধ্য-দক্ষিণপন্থীদেরও একটা বিপুল ভোট লিব্রে পেয়েছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বাচনী সংঘাতের অনুপস্থিতি। কোভিড ইস্যু নিয়ে জর্জরিত ও সদ্য আফগানিস্তানে ধাক্কা খাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৯-এর মতো প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিল। তারা লিব্রে নেতৃত্বদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। এর বিনিময়ে তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। এখনও অবধি যা গতিপ্রকৃতি, তাতে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বোঝাপড়া বজায় রাখছে। তবে লিব্রে নেতৃত্ব চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বপক্ষে যে বক্তব্য রেখেছে, তার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিশ্রুতি ভবিষ্যতেও বজায় রাখবে কিনা, তা দেখার বিষয়।
লিব্রে নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল তারা আদিবাসী অধিকার রক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায় তারা অগ্রণী ভূমিকা নেবে ও পাবলিক সেক্টরকে চাঙ্গা করে নব্য উদারনৈতিক পথ থেকে হন্ডুরাসকে সরিয়ে আনবে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে শিওমারা কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পর কতটা সাফল্য পান, সেটাই এখন দেখার। বলিভিয়ায় সমাজতন্ত্রীদের প্রত্যাবর্তনের পর, ল্যাটিন আমেরিকায় যে আবার একটি বাম জোয়ার দেখা দিয়েছিল তাতে আরেকটি দেশের নাম সংযোজিত হল। সন্দেহের অবকাশ নেই হন্ডুরাসের তো বটেই, সামগ্রিক ভাবে ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বামেদের এই বিজয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন