এবার রাজনৈতিক হিংসায় নিহতের তথ্যেও কারচুপির অভিযোগ উঠলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে রাজ্যে হওয়া রাজনৈতিক হিংসা এবং খুন নিয়ে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে রিপোর্ট দিয়েছে, আরটিআই করে পৃথক পৃথক পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে তার কোনও মিল নেই।
এনসিআরবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনায় মাত্র ৭ টি রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তথ্যের অধিকার আইনে পৃথক পৃথকভাবে পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে রাজনৈতিক হিংসার মোট ঘটনার সংখ্যা ১০১৭ এবং কেবলমাত্র ৯ টি জেলাতেই রাজনৈতিক হিংসার কারণে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এক ডজনের বেশি পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষ হয় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, অথবা এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ সমস্ত তথ্য পাওয়া গেলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সমাজ ও আইন গবেষক এবং আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামীর করা প্রশ্নের উত্তরে এই পার্থক্য ধরা পড়েছে। এই বিষয়ে পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে মঙ্গলবার বিশ্বনাথ গোস্বামী জানান, "২০২১ রাজ্যে নির্বাচন পরবর্তী হিংসার যে মামলা হয়েছিল তাতে আদালতে হলফনামা দিয়ে জানানো হয়েছিল ২ মে থেকে ৬ জুন-এর মধ্যে ২৯টি রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাহলে কোন জাদুবলে সেই সংখ্যা ৭-এ নেমে গেল?”
তিনি আরও বলেন, “রাজ্যে অপরাধের তথ্য পরিসংখ্যান গোপন, তথ্য বিকৃতি এবং তথ্যের জালিয়াতি এক ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলস্বরূপ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “রাজ্যের তথ্য কমিশনের পুরো দখল নিয়েছে বর্তমান তৃণমূল সরকার। নবান্নের নির্দেশে এই সব তথ্য গোপন করা হচ্ছে। সঠিক তথ্য জানানো হচ্ছে না। রাজ্য তথ্য কমিশন আমার সব অভিযোগের শুনানি বন্ধ করে রেখেছে।”
২০২১ সালের এনসিআরবি’র রিপোর্টের জন্য রাজ্য সরকারের প্রেরিত তথ্যে বলা হয়েছে – ২০২১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৩৪ টি এবং তাতে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০০৫ সালের আরটিআই অ্যাক্ট অনুযায়ী রাজ্যের ৩০ টি পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষের কাছে পৃথক পৃথকভাবে রাজনৈতিক হিংসা ও খুনের বিষয়ে তথ্য চেয়েছিলেন বিশ্বনাথ গোস্বামী। ১২ টির বেশি পুলিশ জেলা উত্তর দেয়নি। বাকি জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে অন্তত ১০১৭টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। কেবলমাত্র ৯ টি জেলাতেই ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের প্রথম ৬ মাসে আরও ২ টি রাজনৈতিক খুন এবং ৫৫ টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে।
তথ্যের অধিকার আইনে পাঠানো প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাচ্ছে, সবথেকে বেশি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে কোচবিহার জেলায় – ২০১টি। মৃত্যু হয়েছে মোট ১১ জনের। পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশ জেলায়, ১৩২ টি। এই জেলায় মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। পূর্ব বর্ধমান পুলিশ জেলায় ১২৩ টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে এবং মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এর মধ্যে রাজনৈতিক হিংসায় ৯ জন এবং নির্বাচনী হিংসায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। হুগলী গ্রামীণ পুলিশ জেলায় ৩৭ টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে এবং প্রাণহানি ঘটেছে ৬ জনের। এছাড়াও কৃষ্ণনগর, বারুইপুর, বসিরহাট এবং জলপাইগুড়ি পুলিশ জেলায় ২ জন করে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে কোনও তথ্য দেয়নি মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ। আবার বীরভূম জেলা পুলিশ নির্বাচনী হিংসায় ১৬ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা শূন্য বলে জানিয়েছে। আসানসোল জেলা পুলিশ জানিয়েছে, ৩২টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটলেও কোনও প্রাণহানি হয়নি। প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেছে ডায়মন্ড হারবার জেলা পুলিশ। চন্দননগর এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনারেটও তাই করেছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আত্মহত্যা, সাম্প্রদায়িক হিংসায় মৃত্যুর সংখ্যাও ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রেও এনসিআরবিকে পাঠানো তথ্যের সাথে গোস্বামীর করা আরটিআই’এর তথ্যের বিস্তর ফারাক নজরে পড়েছিল।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন