মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক রাজ্যের বাফালো শহর। এই শিল্পশহর মূলতঃ লৌহ-ইস্পাত শিল্প ও অটোমোবাইল শিল্পের জন্য একদা অতীব বিখ্যাত ছিল। কিন্তু ৮০-এর দশক থেকে বদলাতে থাকা অর্থনীতির প্রভাব পড়ে এই শহরে। এই সময়ে অবশিল্পায়নের জন্য নষ্ট হয়ে যায় শহরের পূর্বতন জৌলুস। বর্তমানে মার্কিন ‘রাস্ট বেল্ট’-এর অন্তর্গত শহর এটি। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দাপট এই শহরে প্রবল। মেয়র বাইরন ব্রাউন এর পূর্বের চারটি নির্বাচন লম্বা ব্যবধানে জিতেছেন। তাঁর সমর্থনে থাকা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মেশিনারির এতই দাপট যে রিপাব্লিক্যানরা সাধারণ নির্বাচনে অনেক সময় প্রার্থী দেওয়া থেকেও বিরত থেকেছে।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে – প্রাইমারি নির্বাচনে। সেখানে ব্রাউনই বিজয়ী হয়েছেন পার্টির স্থানীয় সংগঠন তার পক্ষে থাকায়। এইবার পঞ্চমবারের জন্য নির্বাচনে নেমে ব্রাউন একপ্রকার জিতেই গেছেন বলে সংবাদমাধ্যম ধরে নিয়েছিল। জেনারেল ইলেকশনে এই বছর রিপাবলিক্যান পার্টি প্রার্থী দেয় নি। অতএব ২০২১-এর জুন মাসের ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারির নির্বাচনই ছিল বকলমে মেয়র পদের নির্বাচন। এই প্রাইমারিতে ব্রাউনের জয় ছিল কার্যত নিশ্চিত। মিডিয়ার আলোচনায় প্রশ্নটা এটা ছিল না ব্রাউন জিতবেন কি জিতবেন না, প্রশ্ন এই ছিল তাঁর একেবারে অপরিপক্ক, রাজনীতিতে আনকোরা প্রতিদ্বন্দ্বী, ইন্ডিয়া ওয়াল্টনকে তিনি কত ব্যবধানে পরাজিত করবেন।
বিগত ২৩-শে জুন বাফালোর নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হতেই মিডিয়া সচকিত হয়ে দেখল সমস্ত হিসেব নিকেশকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ব্রাউনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্ডিয়া ওয়াল্টন, তাও স্বল্প ব্যবধানে নয়। ইন্ডিয়া পেয়েছেন ৫১.৮৫% ভোট, অপরদিকে ব্রাউন পেয়েছেন ৪৪.৮৫% ভোট। বলাই বাহুল্য, এই জয় ছিল সকলের কাছেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এর একটা বড়ো কারণ হল, ইন্ডিয়া ওয়াল্টন রাজনৈতিক ভাবে সমাজতন্ত্রী এবং তিনি ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অফ আমেরিকা বা ডি.এস.এ-এর সদস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘সোশ্যালিজম’-এর পক্ষে সওয়াল করা, বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনে, এক প্রকার রাজনৈতিক মৃত্যুকে আহ্বান করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বড়ো কোন শহরে শেষ সমাজতন্ত্রী পদে মেয়র ছিলেন মিলওয়াকির ফ্র্যাঙ্ক পি জেইদলার। এর পরে ১৯৬০-এর দশকের পর কোন বড়ো শহরের মেয়রপদে কোন সমাজতন্ত্রী কখনো অধিষ্ঠিত হয় নি। ঠিক এই কারণেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় সম্পর্কে বাইরন ব্রাউন এতটা নিশ্চিন্ত ছিলেন, ঠিক এই কারণেই তিনি ইন্ডিয়ার সঙ্গে কোন বিতর্কেও অংশ নেননি, ঠিক এই কারণেই সমস্ত মুল স্তরের মিডিয়া ইন্ডিয়া ওয়াল্টনের পরাজয় অবধারিত বলে প্রচার করেছিল। তাঁরা খুব ভুলও ছিলেন এমন না। মার্কিন স্থানীয় রাজনীতির চিরাচরিত গতিপ্রকৃতির হিসেবেই তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তাহলে এমন কি হল, যার জন্য হিসেব মিলল না ? কি ছিল ইন্ডিয়া ওয়াল্টনের গোপন অস্ত্র যাতে তিনি চারবারের মেয়রকে পরাজিত করতে পারলেন ?
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ঠিক এই প্রশ্নেরই জবাব ইন্ডিয়া দিয়েছেন মাত্র এক শব্দে – ‘সংগঠন’। ব্রাউন ও ওয়াল্টন, দুজনেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারিতে লড়লেও ডেমোক্র্যাট এসটাবলিশমেন্টের সমর্থিত প্রার্থী ব্রাউনই সকল আর্থিক এবং সাংগঠনিক সমর্থন পেয়েছেন। এর বিপরীতে ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিলেন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অফ আমেরিকা, ওয়ার্কিং ফ্যামিলিস পার্টি-এর মতো বাম সংগঠনগুলিকে নিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সমস্ত অর্থই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন শহরের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে। অদম্য উৎসাহে পুরো শহর জুড়ে প্রচার করেছেন তাঁর নিজস্ব সংগঠনের উপর ভর করেই।
তাঁর বার্তা ছিল নতুনত্বে পরিপূর্ণ। সাধারণ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান রাজনীতি সাধারণতঃ শ্রেণীর রাজনীতি এড়িয়ে চলে। ইন্ডিয়া কিন্তু তার সম্পূর্ণ প্রচার করে গেছেন শ্রমিকদের শহরে শ্রমিকদের সরকার চাই – এই মর্মেই। দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন – ‘আমরা শ্রমিক, শ্রম আমরাই দিই। তাই আমাদের চাই এমন এক সরকার যা আমাদের জন্য পরিশ্রম করবে।‘ ইন্ডিয়া নিজেই উঠে এসেছেন অত্যন্ত দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার থেকে। ৩৮ বছর বয়সী পেশায় নার্স ওয়াল্টন নিজেও শ্রমিক সংগঠক হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত বাফালো শহরে সাধারণতঃ রাজনীতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেই থাকে, সেখানে ওয়াল্টন যে শ্রেণীর রাজনীতির মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবীদের চিরাচরিত ব্যবধান মুছিয়ে এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছেন তার একটা কারণ হল তাঁর নিজের এই শ্রেণীগত পরিচয়। এর আগেও সমাজতন্ত্রীরা বারবার এই শ্রেণী ঐক্যের প্রকল্পকে সফল করার চেষ্টা করেছে, বারেবারে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
এইবারের সাফল্যের মূল কারণের একটি হল, ওয়াল্টনের শ্রেণী রাজনীতির ধারণা প্রকৃতপক্ষে তাঁর বাস্তব জীবনেরই প্রতিফলন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই তাঁর শ্রেণীর কন্যা – তাই তাঁর বার্তা শ্রমিক শ্রেণীর কাছে আরও অনেক বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। তাঁর আরেকটি অতীব ইতিবাচক গুণ হল বহু তাত্ত্বিকভাবে জটিল বক্তব্যও তিনি অত্যন্ত সহজ ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ‘ফ্রেজমঙ্গারিং’ বা ‘জার্গনমঙ্গারিং’-এর বেড়াজাল কেটে মূল বিষয় মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছেন অতি সহজেই।
ধরা যাক ‘পুলিশ ডিফান্ডিং’-এর বিষয়টি। এটি বর্তমানে সোশ্যালিস্টদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা। কিন্তু বারবার এই অ্যাজেন্ডায় নির্বাচন লড়তে গিয়ে তাঁরা পরাজিত হয়েছেন। ইন্ডিয়া জিতলেন কেন ? তাঁর নিজের বয়ানে, ইন্ডিয়া ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ ও তার পরবর্তী সময়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করেন যে মানুষ পুলিশ ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণ, কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতির উপর পুলিশি অত্যাচার, পুলিশ বিভাগের দুর্নীতি ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু ‘ডিফান্ড দ্য পুলিশ !’ এই স্লোগান সোশ্যালিস্টরা দিলেই মানুষ প্রথমেই ধরে নেন এরা পুলিশ বিষয়টাই তুলে দিতে চাইছে এবং সেই কারণেই তাঁরা তৎক্ষণাৎ এর বিরুদ্ধে চলে যান। প্রকৃতপক্ষে এই স্লোগানের অর্থ যে একেবারেই তা নয় – এইটার বিশ্লেষণ করার সুযোগ সমাজতন্ত্রীরা পাচ্ছেন না – জন্ম নিচ্ছে নানা বিভ্রান্তি।
ইণ্ডিয়া এইখানেই সিদ্ধান্ত নেন তিনি ‘পুলিশ ডিফান্ডিং’ কথাটিই ব্যবহার করবেন না। তার পরিবর্তে এই কথাটির আড়ালে থাকা মূল অবস্থানগুলি, অর্থাৎ পুলিশব্যবস্থার সামরিকীকরণ বন্ধ করা, পুলিশ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বর্ণ-বিদ্বেষ দূর করা, এই ব্যবস্থার খাতে অতিরিক্ত অর্থ না ব্যয় করে সেই অর্থ অপরাধের মূল শিকড়, দারিদ্র্য দূর করতে ব্যবহার করা এইগুলি পৃথক পৃথক ভাবে ভোটারদের কাছে তুলে ধরবেন। বলাই বাহুল্য, তাঁর এই কৌশলে কাজ হয়েছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক অসাম্য-র অবসান ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের অন্যতম অংশ ছিল। ব্রাউনের আমলে প্রো-কর্পোরেট নীতির ফলে বাফালোতে প্রচুর পুঁজির বিনিয়োগ হয়েছে। তাতে ডাউনটাউনের চাকচিক্য বেড়েছে বটে, কিন্তু সাধারণ দরিদ্র মানুষের কোন উন্নতি হয়নি। শুধু কর্মহীন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে। শহরের প্রায় তিরিশ শতাংশ মানুষ এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমে বেড়েই চলেছে। এই চিত্র শুধু বাফালোতে নয়, সমগ্র ‘রাস্ট বেল্ট’ জুড়েই। শ্রমজীবী মানুষের এই ক্ষোভটাকেই অতি-দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট ধারার বক্তব্য রেখে নিজের দিকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ওয়াল্টান দেখালেন এই একই গোষ্ঠীকে বামপন্থীরা নিজেদের দিকেও টেনে আনতে সক্ষম, তবে অবশ্যই যদি তারা নিষ্ঠা ভরে শ্রেণীর রাজনীতি করেন।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বেই শহরের রেন্ট-কন্ট্রোল তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্যান্ডেমিকের ফলে বাড়ি ভাড়া না দিতে পেরে শহরে শহরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধির যে ঘটনা দেখা যাচ্ছে – বাফালোও তার বাইরে না। নির্বাচনে লড়ার সময়েই ওয়াল্টন বলেছিলেন তাঁর প্রথম কাজ হবে রেন্ট-কন্ট্রোল করার প্রক্রিয়া শুরু করা। জয় লাভের পরও তিনি আবার সেই বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। এর আগে কোন প্রশাসনিক পদে না থাকলেও বাফালোর মূল সমস্যাসমূহ ইন্ডিয়ার অধিগত।
নির্বাচনের আগে ‘জ্যাকোবিন’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াল্টন বাফালোর শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা বলতে গিয়ে বলেছিলেন – ‘অনেকেই সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টার উপর কাজ করেও খাবারের জন্য ফুড স্ট্যাম্প, মেডিকেইড এবং অন্যান্য সামাজিক প্রোগ্রামের উপর নির্ভরশীল। যে হারে বাড়ি ভাড়া আর সন্তান প্রতিপালনের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রবল পরিশ্রম করে এমনকি পরিমিত জীবনযাত্রাও অধিকাংশের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে ফেডারাল, রাজ্য এবং স্থানীয় সব স্তরের সরকারই ওয়ালমার্ট বা টেসলার মতো কোম্পানিকে সরকারী ভর্তুকি দিয়ে চলেছে। আমাদের বোঝানো হয় পরিশ্রম করলেই সাফল্য পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। দরিদ্র্য শ্রেণী পরিশ্রম করে সবার থেকে বেশি, কিন্তু উপার্জন করে সবার থেকে কম – সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয় কোন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধা বা সুযোগ ছাড়াই। কঠোর পরিশ্রম ও চুড়ান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপদেশ শুনে শুনে আমাদের সমাজে কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। যৌথ সংগঠন ও সংহতিই একমাত্র এই বদল আনতে সক্ষম।‘
এই সাক্ষাৎকারেই ইন্ডিয়া বলেছিলেন – ‘আমি এমন এক বাফালোর স্বপ্ন দেখি যেখানে কোন হিংসাত্মক সামরিক পুলিশের চিহ্ন নেই, যেখানে সমবায় মালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে যৌথ ভাবে কাজ করার সবার সুযোগ আছে,যেখানে নাগরিকরা তাদের মালিকানাধীন সংস্থায় নিজেদের জন্য কাজ করতে পারে।‘
তাঁর এই স্বপ্নর সামনে কি বিরাট বাধা আছে, ওয়াল্টন জানেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ট্র্যাডিশানাল নেতৃত্ব তাঁর বিরুদ্ধে, বিরুদ্ধে রিপাবলিকান পার্টিও। এই নিয়ে অবশ্য একেবারেই চিন্তিত নন বাফালোর প্রথম সমাজতন্ত্রী ও প্রথম মহিলা মেয়র। নিজের মাতাদর্শের প্রতি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী ওয়াল্টন বরং মনে করেন করেন তাঁর এই জয় ‘আমাদের বহু আগামী বিজয়ের মধ্যে প্রথম মাত্র।‘ ইন্ডিয়া ওয়াল্টনের রাজনীতি ও তার বিজয় এবং তাঁর অসাধ্য সাধন পুনরায় প্রমাণ করল, সমাজতন্ত্রীরা যখন নিজেদের আদর্শের উপর নিজেরা বিশ্বাস করেন, মানুষও করেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন