বিজেপি বনাম তৃণমূলের পতাকা যুদ্ধ, পোষ্টার, ফ্লেক্স যুদ্ধ চলছে। খরচের বহরে দু’দলেরই সমানে সমানে টক্কর। এই পতাকা, পোষ্টার, ফ্লেক্স, দেওয়াল লিখনের যুদ্ধে বামেদের উপস্থিতি ক্ষীণ। যদিও তমলুকের যুদ্ধে বাম প্রার্থী যেভাবে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তার তুলনায় অন্য দলের প্রার্থীরা লড়াইয়ের মাটিতে কতটা আছেন সেটাই এখন বড়ো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে ভোটের আর মাত্র তিনদিন বাকি। প্রচার শেষ হয়ে যাবে ২৩ তারিখ বিকেলেই। বাম প্রার্থী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সব এলাকায় একবার করে মুখ দেখালেও এখনও পর্যন্ত বহু জায়গাতে পৌঁছতেই পারেননি বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অথবা তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য।
যে সাত বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে তমলুক লোকসভা, অঙ্কের হিসেবে সেই সাত কেন্দ্রের মধ্যে চার কেন্দ্রেই (তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, নন্দকুমার, মহিষাদল) বিধায়ক তৃণমূলের এবং বাকি তিন কেন্দ্রে (ময়না, হলদিয়া, নন্দীগ্রাম) বিজেপির। নির্বাচনী পরিসংখ্যানের হিসেব নিকেশে সেখানে বামেরা শূন্য। যদিও বিধানসভা নির্বাচন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে আর লোকসভা নির্বাচন এক নয়। সেখানে থাকে আরও কিছু জটিল অঙ্ক। এবার তমলুক কেন্দ্রে যে অঙ্কের উত্তর কে মেলাতে পারবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। লড়াই চলছে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে।
২০১৪-র ৩৫.২০ শতাংশ ভোট কমে ২০১৬-র উপ নির্বাচনে বাম ভোট হয় ২১.৬২ শতাংশ। ২০১৯-এ যা আরও কমে হয় ৯.৪১ শতাংশ। এবার বামেদের ভোটের হার কী হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৪ জুন পর্যন্ত। তবে এখনও পর্যন্ত এই কেন্দ্রের অঞ্চলে অঞ্চলে ভোটের যে হাওয়া, তা বাইনারি পলিটিক্সের প্রমাদ গোণার জন্য যথেষ্ট।
এই কেন্দ্রে ভোটের আর মাত্র ৩ দিন বাকি। এই সময়েও তমলুক কেন্দ্রের এরকম বহু অঞ্চল এখনও আছে যেখানে খুঁজলে একটাও সিপিআইএম-এর পতাকা দেখা যাবেনা। এরকম বহু গ্রাম আছে যেখানে তৃণমূল আর বিজেপির পতাকা লাগানোর বহরে পাত্তা পাওয়া যাবে না লালের। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় দেওয়াল লেখাও কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। আবার এরকমও অঞ্চল আছে যেখানে পতাকা পোষ্টার দেওয়াল লিখনে কড়া টক্কর বাম-কংগ্রেস, তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে।
কিন্তু পার্থক্য গড়ে দিয়েছে অন্য জায়গা। বাম প্রার্থী সায়ন যেখানে দিন রাত এক করে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে কেন্দ্রের গলি গলি তস্যগলি চষে ফেলছেন, সেখানে খুব কম জায়গাতেই গেছেন বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এমনকি তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্যও বহু এলাকাতেই যাননি। যদিও রাধামণি বাজারের পথসভায় দাঁড়িয়ে দেবাংশু ভট্টাচার্যকে বলতে শোনা গেছে এই তো আমি রাধামণি বাজারে দাঁড়িয়ে মিটিং করছি। আপনারা কখনও দেখেছেন অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে এখানে? অন্যদিকে অনেক জায়গাতেই বাম প্রার্থীকে হাতের কাছে পেয়ে মানুষ ভিড় করছেন, ডাব, জল এগিয়ে দিচ্ছেন, তরমুজ খাওয়াচ্ছেন, হাত মেলাচ্ছেন, সেলফি তুলছেন।
প্রচারের ক্ষেত্রে বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তৃতীয় স্থানে আছেন বললে খুব একটা ভুল বলা হবেনা। অধিকাংশ সময়েই তিনি দিনের বেলা চড়া রোদে প্রচার এড়িয়েছেন, সন্ধ্যের দিকেও নমো নমো করে তাঁর প্রচার। ভোটারদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা অথবা জনতার ভিড়ের মাঝে তাঁর মেজাজ হারানো নিঃসন্দেহে তাঁর মাইনাস পয়েন্ট। তাঁর প্রচারের এই খামতি শুভেন্দু অধিকারী বা অধিকারী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্যারিশমায় কতটা মিটবে এখনই বলা যাচ্ছে না।
সায়নের নিবিড় প্রচারে অধিকারী গড়ে যে ফাটল ধরেছে তা অধিকারী পরিবার ভালো করেই জানে। একইভাবে রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে উঠে আসা বিভিন্ন দুর্নীতি ইস্যুতে তৃণমূলের ভিতও যথেষ্ট নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার সাম্প্রতিক রায় শিক্ষার হারে এগিয়ে থাকা এই জেলায় যে ভালোরকম প্রভাব ফেলেছে তা রাস্তাঘাটে কান পাতলেই বোঝা যায়। এছাড়াও বিগত বিধানসভা নির্বাচনের আসনভিত্তিক ফলাফলের নিরিখেও একদমই স্বস্তিতে নেই তৃণমূল।
প্রচারের ক্ষেত্রেও তৃণমূল এবং বিজেপির পক্ষ থেকে যেভাবে নিজেদের মধ্যে তুই বড়ো না মুই বড়ো করে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে তাও যথেষ্ট শ্রুতিমধুর নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কুরুচিকর মন্তব্য করে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্বাচন কমিশনের কোপেও পড়েছেন। তাঁর প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কমিশন। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীও তাঁর দলীয় প্রার্থীর প্রচারে গিয়ে অধিকারী পরিবারকে বার বার নিশানা করেছেন। এমনকি নন্দীগ্রাম কান্ড অধিকারী পরিবারের পক্ষ থেকেই ঘটানো হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
বাম প্রার্থী সায়ন অবশ্য এসবের ধার ধারেননি। বরং তাঁর প্রচারে বারবার উঠে এসেছে হলদিয়ার উন্নয়ন, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, শিল্পের কথা। তাঁর কেন্দ্রের মানুষের জন্য তিনি কী করতে চান সেই কথা। যা কিছুটা হলেও কেন্দ্রের মানুষকে ভাবিয়েছে। তাঁর জিতবে সায়ন, হবে উন্নয়ন শ্লোগানও বেশ কিছুটা সাড়া ফেলেছে।
এবারের নির্বাচনে রাজ্যের সব কেন্দ্রেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মানুষ কী ভাবছেন? কারণ, অধিকাংশ জায়গাতেই মানুষ খুব চুপচাপ। প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করতে চাইছেন না। সাধারণ ভোটারদের চুপ করে থাকা কীসের ইঙ্গিত তা বুঝতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত। তমলুকের গদিতে আগামী পাঁচ বছরের জন্য জনতা কাকে বসাতে চান তার ফলাফল জানা যাবে সেদিনই।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন