হুজুরাবাদ কেন্দ্রে সাফল্যের পর মুনুগোডে কেন্দ্রে পরাজয় তেলেঙ্গানায় বিজেপির জন্য বড়ো ধাক্কা। এই কেন্দ্রে পরাজয়ের ফলে রাজ্যে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির বিরুদ্ধে একমাত্র বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার যে পরিকল্পনা বিজেপি করেছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। আগামী বছর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই উপনির্বাচনের ফলাফল বিজেপিকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে বলেই মনে করছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহল।
মুনুগোদে কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া যে বিজেপির একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ ছিল তা আর কোন গোপন বিষয় নয়। কোমাতিরেডি রাজাগোপাল রেড্ডির জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে এই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ের হ্যাটট্রিক করতে এবং তেলেঙ্গানাবাসীকে এই বার্তা পাঠাতে চাওয়া হয়েছিল যে বিজেপি একাই কেসিআর-এর নেতৃত্বকে পরাজিত করতে পারে।
বিজেপির কাছে এই উপনির্বাচনের গুরুত্ব এতটাই ছিল যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দলত্যাগী রাজগোপাল রেড্ডিকে বিজেপিতে স্বাগত জানাতে ব্যক্তিগতভাবে মুনুগোডে গিয়েছিলেন এবং জনগণকে তাকে নির্বাচিত করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। শাহ এও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে রাজাগোপালের জয়ের এক মাসের মধ্যে রাজ্যের টিআরএস সরকারের পতন ঘটবে।
বিজেপি মুনুগোডেতে জয়ের বিষয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। কারণ, গত বছর হুজুরাবাদে একই ধরনের কৌশল ফল দিয়েছে। ইটালা রাজেন্দর, যিনি রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার পরে দলত্যাগ করে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন এবং ওই কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলেন। গত বছর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তিনি আসনটি জেতেন। এটি ছিল রাজেন্দরের জন্য এক ব্যক্তিগত বিজয়। তিনি ২০০৯ সাল থেকে এই আসনটির প্রতিনিধিত্ব করছেন।
নির্বাচনী এলাকায় ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় জনসমর্থন পেয়ে রাজেন্দর আসনটি ধরে রাখেন। যদিও, বিজেপি এই জয়কে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উপস্থাপন করতে ব্যবহার করে এবং এই জয়কে ভিত্তি করে টিআরএসকে চ্যালেঞ্জ করে।
এর আগে দুবাকের প্রথম উপনির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জয়ী হয় বিজেপি এবং যার এক বছর পরে হুজুরাবাদে জয় আসে। এই দুই জয়ের পর তেলেঙ্গানায় বিজেপি বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে আসার চেষ্টা শুরু করে।
বৃহত্তর হায়দ্রাবাদ মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে (GHMC) বিজেপির চিত্তাকর্ষক পারফরম্যান্স এর পরেই ছিল। পুরসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারে নেতৃত্ব দেন অমিত শাহ এবং দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা সহ শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিজেপির আক্রমণাত্মক প্রচারের ফলে ১৫০-সদস্যের পৌরসভায় বিজেপির আসন ৪ থেকে বেড়ে হয় ৪৮।
২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং যে নির্বাচনে টিআরএস ৮৮ আসন জিতে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। বিজেপি ওই নির্বাচনে মাত্র একটি আসনে জয়ী হয়। ন’টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে আসে এবং বেশিরভাগ আসনেই বিজেপি প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
যদিও এর কয়েক মাস পরে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি চমক দেখায়। যে নির্বাচনে সেকেন্দ্রাবাদ আসন ধরে রাখার পাশাপাশি টিআরএস থেকে অন্য তিনটি আসন দখল করে - করিমনগর, নিজামবাদ এবং আদিলাবাদ।
দুব্বাক এবং হুজুরাবাদ বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজয় এবং জিএইচএমসি নির্বাচনে ভাল প্রদর্শন গেরুয়া শিবিরের মনোবলকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তেলেঙ্গানায় ক্ষমতায় আসার জন্য 'মিশন ২০২৩'-এর সাথে রাজ্যের প্রতি মনোযোগ বাড়ায় এবং কর্ণাটকের পরে তেলেঙ্গানাকে দক্ষিণ ভারতের দ্বিতীয় রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করে।
এই কৌশলের অংশ হিসাবে, বিজেপি এই বছরের জুনে হায়দরাবাদে জাতীয় কার্যনির্বাহী সভা করেছে। জাতীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আগে এবং পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং জেপি নাড্ডা সহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একাধিক সফর তেলঙ্গানায় বিজেপি ক্যাডারদের মনোবল বাড়িয়ে তুলেছে।
এই ঘটনার পরেই তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে সি আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির উপর আক্রমণ জোরদার করে এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়।
রাজাগোপাল রেড্ডিকে দলে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা এবং মুনুগোদে উপ-নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া এই কৌশলের একটি অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
হুজুরাবাদের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে টি আর এস সর্বাত্মক চেষ্টা করে এবং মুনুগোডেতে গেরুয়া ঢেউ থামিয়ে দেয়। কে সি আরের দল জানিয়েছে, 'রাজগোপাল রেড্ডির এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন যে তাঁর পারিবারিক সংস্থা সুশি ইনফ্রা কেন্দ্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার চুক্তি পেয়েছে৷
টিআরএসের কার্যকরী সভাপতি কে টি রামা রাও দাবি করেন, রাজাগোপাল রেড্ডি অমিত শাহকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি উপনির্বাচনে জিততে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করবেন।
২৬শে অক্টোবর হায়দরাবাদে টিআরএস-এর চারজন বিধায়ককে কেনার চেষ্টা করার সময় তিনজন কথিত বিজেপি এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়। যে ঘটনা ভোট প্রচারের মাঝখানে গেরুয়া শিবিরকে বিব্রত করে।
যদিও বিজেপি নেতারা এই ঘটনাকে মুনুগোডে আসনে পরাজয়ের ভয়ে কেসিআর-এর তৈরি করা নাটক বলে অভিহিত করে।
কেসিআর দাবি করেছেন যে তার সরকারকে ফেলার জন্য বিজেপির ষড়যন্ত্রই তিনি শুধু ব্যর্থ করেননি। বরং দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং রাজস্থানে সরকার পতনের পরিকল্পনার প্রমাণও সংগ্রহ করেছেন।
বিজেপি এজেন্টদের মাধ্যমে ঘটানো এই ঘটনাকে জাতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়া এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য চাপ দেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কেসিআর। তিনি ভারতের প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি এবং সমস্ত হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিদের কাছে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আবেদন করে বিষয়টিকে জাতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেবার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন