১৯৯০ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতায় এলেন ইয়াসির আরাফাত। পরের দুই দিনের দৈনিকে আরাফাতের সঙ্গে জ্যোতি বসুর ছবি আমরা দেখেছিলাম। ইজ়রায়েল আর প্যালেস্টাইনের কথা খুব বেশী করে সেই সময় বাংলা বয়ানে উঠে আসে। আরাফাত তখন বামপন্থী সেকুলার সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যান। সেই সংগঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল প্যালেস্টাইনকে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত প্যালেস্টাইনের কমিউনিস্ট পার্টি, পিসিপিকে অবশ্য পিএলও পাশে পায়। নতুন এই কমিউনিস্ট দলটি ১৯৮৭ সালে পিএলওতে যোগ দেয়।
আরাফাত আরবি-ভাষী প্যালেস্টিনীয়দেরও পাশে পেলেন। প্যালেস্টিনীয় বা ফিলিস্তিনি পরিচয়ে যাদের আমরা লৌহ যুগ থেকে কেইনানের দক্ষিণ উপকূলে বসবাসকারী প্রাচীন মানুষ হিসেবে জানতাম, তাদের সকলকেই যে পেলেন, এমনটি বলা ঠিক হবে না। আরব-কেন্দ্রিক ক্ষমতা প্রসারে ইহুদিদের সঙ্গে সেই সম্পর্ক ইতিহাসের কোনো বাঁক নির্মাণ করেছে কিনা সেটা আজকের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় নয়। এই আলোচনা কেবলমাত্র ইহুদি উপনিবেশ হিসেবে ইজ়রায়েলের জন্ম উপকথার ভূ-রাজনীতিতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবে।
আজকে ইজ়রায়েল বা ফিলিস্তিন নামক ভূ-রাজনৈতিক স্থানটি রোমান সময় থেকেই একটি স্বীকৃত দেশ। সেই ভূখণ্ডে ১৮৮০ সালেও ইহুদি জনসংখ্যা হাজার পঁচিশের মতো ছিল। তাদের মধ্যে একটা অংশ আবার গোঁড়া প্রকৃতির ইহুদি, যারা ‘চারিভি’ নামে পরিচিত। ১৮৮১র রাশিয়ান পোগ্রোমের ঢেউ এই অঞ্চলকে প্রভাবিত করে, যা ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেই সময় ইউরোপে ইহুদিবাদী আন্দোলন দেখা দেয়। প্রথম আলিয়া, ১৮৮২ সাল, সেও এক ইহুদি ঢেউ। এটি কৃষি আলিয়া নামেও পরিচিত যা অটোমান সিরিয়ায় ইহুদি অভিবাসনের একটি প্রধান তরঙ্গ ছিল। এই তরঙ্গে অভিবাসিত ইহুদিরা বেশিরভাগই পূর্ব ইউরোপ এবং ইয়েমেন থেকে এসেছিল। ১৯০৪ সালের মধ্যে প্রায় পঁচিশ হাজারেরও বেশী সংখ্যক ইহুদি অটোমান প্যালেস্টাইনে অভিবাসিত হন। প্যালেস্টাইনে নগরায়নের ঢেউ লাগে। এখানে রিশন লেজিওন, জিক্রোন ইয়াকভ, রোশ পিনার হয়ে ওঠে ইহুদি নগরজীবনের ভিত্তি।
১৮৯৭ সালে বাসেলে প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা পায়। দ্বিতীয় জায়নবাদী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় পরের বছর। এবং তার পর থেকে প্রতিটা বছরেই প্রায় একের পর এক জায়নবাদী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯০১ সালে ইহুদি জাতীয় তহবিল (জেএনএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় আলিয়া, যা ছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার ইহুদির অভিবাসন। এই সংখ্যক ইহুদির বেশিরভাগই অভিবাসিত হয়েছিলেন রাশিয়ান সাম্রাজ্য থেকে। অপর কিছু ইয়েমেন থেকে সেই অটোমান শাসিত প্যালেস্টাইনে আসেন। এরই মাঝে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রথমটি হল প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের নিজেদের অফিস প্রতিষ্ঠিত হওয়া, যা ১৯০৮ সালে ঘটে। এবং দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯০৯ সালে ঘটে, যেখানে তেল আবিবের ভবন নির্মাণের পাশাপাশি হাশোমার প্রতিষ্ঠিত হয়। হাশোমার ছিল প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের নিজস্ব একটি প্রতিরক্ষা সংস্থা।
ঔপনিবেশিক রাজনীতির আঙিনায় এই ফিলিস্তিন হল এশিয়ায় ইউরোপের ঘাঁটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলটিকে নিয়ে তাই প্রথমে একা ইংরেজরা, এবং পরে ইংরেজ ও ফরাসিরা নিয়ন্ত্রণের কৌশলে ফন্দি এঁটেছে। ১৯১৫-১৬ সালের মধ্যে হুসেন-ম্যাকমোহন চিঠিপত্রের যে প্রমাণ আমরা দেখি, সেখানে যুক্তরাজ্যের ইংরেজ সরকার আরবের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছিল, এবং মক্কা শরীফের বিনিময়ে যুদ্ধের পর এই বৃহৎ অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহকে ইন্ধন জুগিয়েছিল। ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকট চুক্তি। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মধ্যে এই গোপন চুক্তিটি ঘটে রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং ইতালির সম্মতিতে।
এর ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত বিভাজনে এই অঞ্চলে পারস্পরিকভাবে সম্মত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রগুলি সংজ্ঞায়িত হয়। কিন্তু পরের বছরের ২রা নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা দেয়। সেই পাবলিক বিবৃতিতে বলা হয় যে ফিলিস্তিনে একটি "ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় বাড়ি" প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ব্রিটিশ সামরিক প্রশাসন কাজ করবে। এই ঘোষণার মধ্যে দিয়েই অটোমান অঞ্চলে একটি সংখ্যালঘু ইহুদি ক্ষুদ্র জনসংখ্যার সহযোগিতায় ১৯১৭ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিন দখল করে এবং ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে শাসন করে।
১৯২০ সালের ১৯-২৬ এপ্রিল, ইতালিতে যে সান রেমো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলন ফিলিস্তিনের উপর ব্রিটেনকে ম্যান্ডেট দেওয়ার অধিকারে বৈধতা দেওয়া হয়। ব্রিটেন দুটি ম্যান্ডেট জারি করে। প্রথম ম্যান্ডেটে হাগানাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল প্রধান ইহুদিবাদী আধাসামরিক সংস্থা, যা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইশুভের জন্য কাজ করতে শুরু করে। দ্বিতীয় ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অনুসারে ইশুভের জন্য কাজ করতে শুরু করে ইহুদিবাদী শ্রমিক কুল। তারা শ্রমিক সংগঠন হিস্তাদ্রেত প্রতিষ্ঠা করে। এটি শ্রমিকদের সাধারণ সংগঠন হলেও শীঘ্রই তা ইজ়রায়েলের মাটিতে ইশুভের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রসঙ্গত এই ইশুভের যুগ হল ফিলিস্তিনে ইহুদি উপনিবেশ হিসেবে ইজ়রায়েলের নাড়ি। উনিশ শতকের আটের দশক থেকে ফিলিস্তিনে যে জায়নবাদী অভিবাসন শুরু হয় তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে একটা কাঠামো পায়। এই পাঁচ দশকের সময়কালই হল ইশুভের যুগ। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সফল হওয়ার পরে আলেকজান্ডার কেরেনস্কির নেতৃত্বে চলা অস্থায়ী সরকারের অনেক নেতা, যারা ইহুদি হিসেবে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, তারা রাশিয়া ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। সেই সংখ্যাটাও কম নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন পিতিরিম সোরোকিন, যিনি পরবর্তীতে আমেরিকান সমাজতাত্ত্বিক পরিচয়ে জগতখ্যাত হয়েছিলেন।
আমেরিকান মুলুকে ইহুদি প্রভাব মার্কিন কংগ্রেসকে ব্রিটেনের পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়। ১৯২২ সালে মার্কিন কংগ্রেস বেলফোর ঘোষণাকে অনুমোদন করে। ব্রিটেন ট্রান্সজর্ডানকে একটি পৃথক রাজনৈতিক সত্তা এবং আমির আবদুল্লাহকে এর শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছর প্যালেস্টাইন এবং ট্রান্সজর্ডানের উপর ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্রথমে লিগ অফ নেশনস দ্বারা অনুমোদিত হয়, তারপরে লুসানের চুক্তিতে জন্ম নেয় তুরস্ক। এই চুক্তিটি আধুনিক রাষ্ট্র তুরস্কের সীমানাকে স্বীকৃতি দেয়। তুরস্ক তার প্রাক্তন আরব প্রদেশগুলির কোনো অংশ দাবি করেনি, বরং সাইপ্রাসের ব্রিটিশ দখল এবং ডোডেকানিজদের ইতালীয় দখলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিশ শতকের দুই ও তিনের দশক জুড়ে ফিলিস্তিন দ্রুত উত্তপ্ত হতে থাকে। একদিকে ইহুদি অভিবাসনের ফলে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি অভিবাসীদের আর্থিক সহায়তার সঙ্গে ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক সহায়তা, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী রাষ্ট্র গঠনের কাজটিকে সহায়তা করে। ইহুদি-প্রধান একটি রাষ্ট্র, যা হল তাদের জাতীয় আবাস। সেই লক্ষ্যে এই সময়ের মধ্যে হাগানাহ ও হিস্তাদ্রেত তাদের সংগঠনকে বৃহৎ মাত্রায় প্রসারিত করতে সক্ষম হয়। ইহুদি জাতিসত্তায় ভর করে রাজনৈতিক এবং সামরিক হাতিয়ারের ব্যবহারে জায়নবাদী জাতীয়তাবাদের প্রয়াস জোরদার হয়। হাগানাহের অভ্যন্তরে আরও জঙ্গি উপাদানগুলি ক্রমে দ্রুত বেড়ে যায়। ১৯৩১ সালে হাগানাহ থেকে ইরগুন বিভক্ত হয়। হাগানাহের মাত্রাতিরিক্ত জঙ্গি উপাদানগুলির সমন্বয়ে গঠিত সামরিক অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ইরগুন তসওয়াই-লিউমি (জাতীয় সামরিক সংস্থা) গঠন করে, যা ওই ‘ইরগুন’ নামে বেশি পরিচিত।
প্যালেস্টাইনের মাটিতে তিনের দশকটি দাঙ্গার দশক হিসেবে চিহ্নিত। ভাষা, ধর্ম, বৈদেশিক ইন্ধন, ইত্যাদি পার্থক্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। ইজ়রায়েল নামের জায়নবাদী ভূ-রাজনীতি তখন লালিত হচ্ছে ব্রিটিশ-মার্কিন যৌথ নজরদারিতে। ১৯৩৬র এপ্রিলে দুই ইহুদিকে হত্যার ঘটনায় শুরু হয় সাধারণ ধর্মঘট। আরব রাজনৈতিক দলগুলো জেরুজালেমের মুফতি আমিন আল-হুসাইনির সভাপতিত্বে একটি আরব উচ্চতর কমিটি গঠন করে। ব্রিটিশ প্রশাসনের ইহুদি পক্ষপাত দাঙ্গার আগুনকে বিদ্রোহে পরিণত করে।
প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেটের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি আরবদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। একই কাজের জন্য একজন ইহুদি ছাড় পেলেও একজন আরবি ভাষী মুসলিম চরম শাস্তির মুখোমুখি হন। শুরু হয় বিদ্রোহ, আরব বিদ্রোহ, ইহুদিদের সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। এটি পরে মহান ফিলিস্তিন বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়, যখন তা আরবি ভাষী ইহুদিদের সমর্থন লাভ করে। ‘চারিভি’ নামে পরিচিত এই সনাতনী ইহুদি অংশের সঙ্গে ইসলামের যতটা অপরভাব ছিল, তার থেকেও বেশী তাঁরা জায়নবাদী রাজনীতিতে ইহুদি জাতিসত্তার ঔপনিবেশিক ব্যবহারকে বিরোধিতা করেন। এই বিদ্রোহকে ইহুদি ইশুভের অনেকেই ‘অনৈতিক’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিহিত করেছেন। আকাডেমিক রূপকালঙ্কারে এই আরব আক্রমণকে হিংসার বৈশিষ্ট্যে প্রায়শই ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসিবাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
আরব প্রতিরোধ বিদ্রোহের আকার নিলে ব্রিটিশ সরকার নড়ে বসে। হিংসার কারণ এবং সরকারের বিধান দেওয়া ম্যান্ডেটের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য সরকার লর্ড পিলের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করে। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে জারি করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে, পিল কমিশন ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সুপারিশ করে। একটি ইহুদি এবং একটি আরব। ১৯৩৯ সালে সামরিক কোর্ট প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সেই বিদ্রোহকে কিছুটা শান্ত করা সম্ভব হয়। অপরদিকে এই সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় হাগানাহের সামরিক পদ্ধতিবিদ্যায় পরিসংখ্যানবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি ঘটে। গণনা, বর্গীকরণ, ইত্যাদিতে অত্যাধুনিক উপাত্ত সংশ্লেষ সমর অভিযানের অংশ হয়ে ওঠে।
এই সময় জঙ্গি ইরগুন থেকে একটা অংশ লেহি নামে গঠিত হয়। তাদের কাজ হল অতর্কিতে আক্রমণ এবং ধ্বংসের কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করা। ১৯৪০-এ আরব কুলে এরা স্টার্ন গ্যাং নামে চিহ্নিত হয়। কলঙ্ক চিহ্ন। এই সংহারী গোষ্ঠী বাধ্যতামূলক প্যালেস্টাইনে আব্রাহাম (ইয়াইর) স্টার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি জায়নবাদী আধাসামরিক কড়া জঙ্গি সংগঠন। এরা আরব গ্রামগুলিকে তার জনসংখ্যার ভিত্তিতে বয়স ও লিঙ্গ উপাত্তে নথিভুক্ত করে। জায়নবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে এই সময় গ্রাম ফাইল প্রকল্প চালু হয়, যেখানে একটি কার্ড সূচক সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে গ্রামের ফাইলগুলি তৈরি করা হয়। মুসলিম ও ইহুদি-বিদ্বেষী গ্রামের বিস্তারিত তথ্য সহ এই ফাইলগুলি হল সামরিক গোয়েন্দা নথি। এইগুলিই হল জায়নবাদী সশস্ত্র অপারেশনের ভিত্তি।
প্রত্যাঘাত অনিবার্য হয়। সেই পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে অ্যাংলো-আমেরিকান কমিটি অফ ইনকোয়ারি গঠিত হয়। এটি ছিল একটি যৌথ ব্রিটিশ এবং আমেরিকান কমিটি। উভয় দেশের ছয়জন করে সদস্য কমিটিতে ছিলেন। বাধ্যতামূলক প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এবং বর্তমানে বসবাসকারী জনগণের কিসে ভালো হয় তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব এই অ্যাংলো-আমেরিকান কমিটিকে দেওয়া হয়। ১৯৪৬ সালের ৪ জানুয়ারী ওয়াশিংটন, ডিসি-তে সদস্যগণ আলোচনায় বসেন। কমিটি আরব এবং ইহুদি প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন। সমস্যাগুলির অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তাদের স্থায়ী সমাধানের জন্য কমিটি দশটি সুপারিশ করে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান প্যালেস্টাইনে লক্ষাধিক ইহুদির আবাস নিশ্চিত করেন। ব্রিটিশ ও মার্কিন সহায়তায় ইশুভের যুগ পরিপূর্ণতা পেতে থাকে।
উনিশ শতকের আটের দশকে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন জেগে উঠেছিল, জাতীয়তাবাদী ইহুদিবাদ বা জায়নবাদ একটি দখলের আন্দোলনে তাকে বাস্তবায়িত করে। থিওডর হার্জল ছিলেন সেই আধুনিক রাজনৈতিক জায়নবাদের জনক। উনিশ শতকের সেই আটের দশকেই হার্জল ইহুদিবাদী সংস্থা গঠন করেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের পক্ষে প্রচার সংগঠিত করেন। তবে এই ইহুদিবাদ কখনোই কোনো অভিন্ন আন্দোলনের ধারা গঠন করতে পারেনি। আন্দোলনের নেতৃত্ব, দলীয় মতাদর্শগুলি প্রায়শই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। রাজনৈতিক জায়নবাদ, উদার জায়নবাদ, শ্রমিক জায়নবাদ, সংশোধনবাদী জায়নবাদ, সাংস্কৃতিক জায়নবাদ এবং ধর্মীয় জায়নবাদ সহ বিভিন্ন ধরনের জায়নবাদের উদ্ভব ইতিহাসে ঘটেছে। ইজ়রায়েলের ইতিহাসে জায়নবাদ ইশুভের যুগে লালিত হয়।
উনিশ শতকের সেই আটের দশক থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলা ইহুদি অভিবাসনের এই সময়কালকে উল্লেখ করে “ইশুভের যুগ” শব্দবন্ধটি একটি ঐতিহাসিক ধারণায় পরিণত হয়েছে। শব্দটি জায়নবাদের উন্মেষ ও বিকাশের ধারাবাহিকতাকে প্রকাশ করে। এই যুগে জায়নবাদ ইজ়রায়েল প্রতিষ্ঠায় জাতিকেন্দ্রিকতায় আশ্রয় নেয়। ফিলিস্তিনের মাটিতে পঁচিশ হাজার থেকে ছয় লক্ষ তিরিশ হাজার ইহুদির বসবাসে সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। পরবর্তীতেও অবশ্য এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসরে জার্মানি থেকে ইহুদিদের বিতারণ, ফিলিস্তিনে ইহুদি সংগঠিতকরণের কাজটিকে সহজ করে তোলে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের ওপর নাৎসি বর্বরতার কাহিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছড়িয়ে পড়লে ইহুদিবাদের বিশ্বায়ন ঘটে। ন্যুরেমবার্গ বিচারসভা যে বর্বরতার ইতিহাস বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়, তাতে ইহুদিদের প্রতি বিশ্বমানবের সহমর্মী মন গড়ে ওঠে। অথচ সেই অভিবাসিত ইহুদিই প্যালেস্টাইনে নতুন করে ধর্মযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে তোলে। ফিলিস্তিনে সামরিক অভিযানে আরব গ্রাম জ্বালানোর ঘটনা অত্যাধিক মাত্রায় বেড়ে গেলে ব্রিটেন তার ম্যান্ডেটের সমাপ্তি ঘোষণা করে এবং সমস্যাটিকে জাতিসংঘে স্থানান্তর করে। জাতিসংঘ একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে, UNSCOP, যা দেশভাগের সুপারিশ করে। সেটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (রেজোলিউশন ১৮১) দ্বারা অনুমোদিত হয়। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হয়, জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু হয়।
বিস্তীর্ণ ফিলিস্তিন জুড়ে তখন শুধু ধ্বংসের ছবি। অর্ধেক গ্রাম ধ্বংস করে, মোট বারোটি শহরের মধ্যে এগারোটিকে খালি করে, অর্ধেক মুসলিম জনসংখ্যার বিতাড়নকে হিংসায় সম্পাদন করে এবং ধ্বংস করার সময় প্রতিবেশী আরব দেশগুলি থেকে ফিলিস্তিনে প্রবেশকারী সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। ইহুদি রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ান স্বীকৃত সার্বভৌম ভূখণ্ড। ইশুভের যুগ-পূর্ব ফিলিস্তিন মানচিত্রে সেই ইজ়রায়েল হল এক নতুন সামরিক জায়নবাদের উজ্জ্বল চিহ্নক।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন