অলৌকিক আখ্যান বলাই ভালো। ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্বের রাজনীতি প্রসঙ্গে তেমনটিই হয়তো বলা যায়। সমালোচকগণও আজকাল তেমনটিই বলছেন। উপনিবেশ উত্তর সাহিত্যে সেই রকম প্রতিফলন ঘটেছে বলেই হয়তো তারা সেটা বলতে পারছেন। আখ্যানের পরতে পরতে রয়েছে জাদুকরী চিন্তাধারার প্রতিফলন। হঠাৎ করেই গণতন্ত্র এখানে জাতিতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এও এক প্রকারের প্রতিকল্পীয় বাঁক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিবাদকে এমন একটি সময়ে উপনিবেশবাদী জাতিতন্ত্রের প্রকল্পে পরিণত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যখন সভ্য বিশ্ব উপনিবেশবাদের আগ্রাসনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই লগ্নে সাম্রাজ্যবাদী প্রকৌশলে ইজ়রায়েল নামক একটি ইহুদি রাষ্ট্রের সৃষ্টি সমগ্র ইউরোপকে, বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানিকে, সবচেয়ে খারাপ পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি সহজ উপায় বাতলে দেয়। শাসন ও শোষণের ঘৃণ্য অভীপ্সায় নির্মল মোড়ক হয়ে ওঠে মুক্তির আখ্যান।
মোজেস সর্বত্রাতা, মুক্তিদাতা হয়ে সেই আখ্যানে হাজির হয়েছেন অবশ্য অনেক আগেই। সিনাই সেখানে ঘরানায় ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। আব্রাহাম, মূলত আব্রাম, হয়ে উঠেছেন ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের হিব্রু পিতৃপুরুষ। ইসলামে তিনি হয়েছেন আদম থেকে মুহাম্মদের মধ্যে অন্যতম সংযোগ সূত্র। নবী-সূত্রের একটি অন্যতম ‘মিসিং লিঙ্ক’। একজন ইহুদির ধর্মাচরণে তিনিই হন ঈশ্বরের প্রধান দূত। আবার খ্রিস্টধর্মে তিনিই হলেন ধর্মবিশ্বাসীর আধ্যাত্মিক বংশধর।
সেই ধর্মসূত্রে ইহুদিবাদের কাছে একজন খ্রিস্টান হলেন অনুদিত ঈশ্বরের উপাসক। ভাষা হয়ে ওঠে ধর্মের অনুরূপ। ধর্মের অনুক্ষণে ভাষার সেই হাজিরা গ্রাহ্য হয়েছে ‘টুনাহ’ রচনার সময় থেকে। সেই সময় থেকেই হিব্রু এবং আরবিকে পবিত্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ভাষা আর ধর্ম হয়ে উঠেছে একে অপরের পরিপূরক। ইহুদি বিশ্বাসে ধর্মগ্রন্থে যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা হল আসল, ঈশ্বরের প্রকৃত শব্দ। হিব্রু বাইবেলজাত এই পরিচিতিকে অবচেতনে কেউ ইতিবাচক বা সমাজপন্থী হিসেবে কল্পনা করতেই পারেন।
ধর্মের এই আদি রূপ-কল্পনা অলৌকিক। ঠিক যেমন ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের অবসান হল আর এক জাদুকরী বয়ান-বিন্যাস। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও তাই হল এক অতিকথন। সেই আখ্যানে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) এবং গাজ়া উপত্যকায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সীমানাহীন বিস্তৃতি। সেই অবরুদ্ধ অঞ্চলের সঙ্গে ইজ়রায়েলের একটি আনুষ্ঠানিক শান্তি চুক্তির অধীনে সকল প্রকার শত্রুতার অবসান ঘটে। শান্তির এই অলৌকিক বিশ্বাস দ্বিতীয়বারের জন্য অসলো নীতিমালার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে সাহায্য করে।
নয়ের দশকে নোবেল আসে, কিন্তু শান্তি আসে না। শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ার সকল দস্তাবেজ বিভাজনের উপর জোর দেয়। অগ্নিগর্ভ এজেন্ডা থেকে উদ্বাস্তু ইস্যুকে বাদ দেওয়া হয়। এই অসলো প্রক্রিয়াটি সর্বোত্তমভাবে একটি সামরিক পুনঃনিয়োগ এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সহ গাজ়া উপত্যকায় ইজ়রায়েলি নিয়ন্ত্রণের পুনর্বিন্যাসের কাজটিকে সম্পূর্ণ করে। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে ধর্মীয় উস্কানি ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তাকে কানে তোলে না। ফাতাহ, পিএলও, পিসিপি, সিপিআই দুর্বল হয়।
উত্তর-কাঠামোবাদী বয়ান এই সম্পর্কিত জাদুকরী চিন্তাধারাকে লৌকিক করে তোলে। জ্ঞানের আমূল অনিশ্চয়তায় সত্য আপেক্ষিক হয়ে ওঠে। বিনির্মিত দর্শনের সেই নয়ের দশক তাই আপন আপন সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির আদলে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সম্পর্ককে ক্রমাগত দ্রুত পরিবর্তনের দ্যুতিতে দেখে। ফিলিস্তিনের মাটিতে বিশ্বায়নের বেদনা ইহুদিকরণে জেগে ওঠে। ভাষাজাত ধর্মীয় পরিচিতি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে আঁকড়ে ক্ষমতা-কাঠামোকে দখলে রাখতে চায়।
রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী দল লিকুদ, শক্তি সঞ্চয় করে হেরুট দলের জোরালো সহযোগিতায়। জাতিতন্ত্রের জাদুবলে হেরুট লিকুদে মিশেছিল আটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, আর নয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই অলৌকিকের লৌকিক হাজিরায় ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রাবিনকে খুন হতে হয়। লেবার পার্টিতে তিনি ছিলেন একজন আশকেনজি জ়ায়নবাদী, যিনি তার আগের বছরই ইয়াসির আরাফাত ও শিমন পেরেসের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
নতুন শতাব্দীর বিশ্বায়ন সামরিকীকরণের পথকে করে প্রশস্ত। ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইনের সংঘর্ষপূর্ণ মাটিতে অস্ত্রের ঝলকানি বেড়ে যায়। চুক্তিনির্ভর শান্তির প্রক্রিয়ায় জাতিবাদ উপড়ে ফেলা সম্ভব হয় না। উপরন্তু গেড়ে বসে বিদেশাতঙ্ক। সেই আতঙ্ক ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে নাজিবাদ এবং এর বাইরে একটি নৃশংস উপনিবেশবাদের জন্ম দেয় ও লালন করে। যাপিত হয় বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদ।
দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল লিকুদের সঙ্গে লেবার পার্টির রাজনৈতিক বিতর্কের মাঝে হামাস তার সংগঠনে ফিলিস্তিন মুক্তির ডাক দেয়। আরবভাষী সুন্নি ফিলিস্তিন সামাজিক বৈষম্যের জাল ছিঁড়তে হামাসের জিহাদ মতাদর্শে অনুরক্ত হয়। ২০০০র সেপ্টেম্বরের শেষে পিএলও, ফিলিস্তিন কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য কিছু ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের চেষ্টায় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর তীব্র সমালোচক এহুদ বারাকের ক্ষমতাসন তখন টাল খাচ্ছে। বিল ক্লিনটন সরাসরি আরাফাতের সঙ্গে কথা বলেও রাজনৈতিক উত্তাপ কমাতে ব্যর্থ হন। বধ্যভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী পক্ষপাত, হিংসার জ্বলনাঙ্ক বজায় রাখে।
আগুনের ঝাঁজ শান্তিকামী ফিলিস্তিনিদের জীবনকে আগের চেয়ে অনেক খারাপ করে তোলে। লিকুদ দলের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। লিকুদ প্রধান এরিয়েল শ্যারন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে আসেন। মুসলিম এবং ইহুদি – উভয় জনসম্প্রদায়ের কাছেই আল-আকসা এলাকাটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ঐতিহাসিকভাবে সেই বিবাদের ইস্যু এই নির্বাচনে কেন্দ্রীয় এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গত, এই আল-আকসা মসজিদটি যে কমপ্লেক্সে অবস্থিত মুসলিমদের কাছে সেটি আল-হারাম আল-শরীফ এবং ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত।
এই চমকের রাজনীতিতে ২০০১ সালে শ্যারন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরের বছর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অঞ্চলের সীমানা হিসেবে ‘প্রাচীর প্রকল্প’ অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০০৩ সালে। পরের বছর ১১ নভেম্বর ফিলিস্তিনি শান্তিকামী মানুষ তাঁদের অভিভাবককে হারান। ইয়াসির আরাফাতের ইন্তেকাল ঘটে।
ক্ষমতার মধ্যগগনে তখন শ্যারন। সাবরা এবং শার্টিলা গণহত্যার নায়ক। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিতকরণের একজন নিখুঁত কারিগর। সেই শ্যারন ২০০৫ সালে নির্বাচনের আগে লিকুদ এবং লেবার পার্টির নেতৃত্বকে ভাঙিয়ে নিজের দল কাদিমা গঠন করেন এবং নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভ করেন। শ্যারন পুনঃনির্বাচিত হলে সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে ব্যাপক মাত্রায় অস্থিরতা দেখা দেয়। সামাজিক অনুমোদন, রাজনৈতিক বয়কট, আর্থিক মন্দা ইত্যাদি সামাজিক আন্দোলনে নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। সেই চাপে গাজ়া বসতিতে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলিকে সরিয়ে নিতে ইজ়রায়েল বাধ্য হয়।
আরাফাত উত্তর ফিলিস্তিন জনমানসে হামাস প্রতিহিংসার রাজনীতিতে ক্ষমতাশালী হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইসলামের মতবাদের ঐক্যেই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার আহ্বানে তারা সুন্নি মুসলিমদের সহজেই সংগঠিত করে। জ়ায়নবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি ‘ইসলামিক পবিত্র যুদ্ধ’র নামে সংগঠিত ধর্ম পরিচিতিসত্তায় জারিত হয়ে সন্ত্রাসী হয়ে উঠে। দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে জিহাদ হয়ে ওঠে পবিত্র যুদ্ধ।
সেই বিশ্বাসে ২০০৬ সালে হামাস দ্বিতীয় ফিলিস্তিন আইন পরিষদের (পিএলসি) নির্বাচনে জয়লাভ করে। ইজ়রায়েল, মধ্যপ্রাচ্য কোয়ার্টেট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন), বেশ কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং আরব রাষ্ট্র, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের উপর সকল ধরনের বিদেশী সহায়তায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর্থিক সহায়তা স্থগিত হয়ে যায়। গাজ়া উপত্যকায় আবার অবরোধ শুরু হয়।
মানব বোমা মতাদর্শে হামাস, হামলার রাজনীতি জারি রাখে। সামরিক কৌশলে ইজ়রায়েল তার উত্তর অংশে হিজবুল্লাহ আধাসামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। শুরু হয় দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ, শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ইহুদি আক্রমণ। একই সঙ্গে গাজ়ায় শিয়া এবং আহমদী মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এই সংঘর্ষে ইজ়রায়েল ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে। ক্লাস্টার বোমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি জৈবিক অস্ত্র হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই তৈরি করেছিল। অলৌকিক মার্কিন ছোঁয়ায় সামরিক অস্ত্রের বাণিজ্যক্ষেত্র হয়ে উঠে ফিলিস্তিন অঞ্চল।
শিয়া সম্প্রদায়ের উপর হিংসাশ্রয়ী নিপীড়নে হামাস প্রাথমিকভাবে খুশী হলেও ফিলিস্তিনের মুক্তি লাভে ইজ়রায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে তারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ করতে শুরু করে। ২০০৬ সালে ধূর্ত ঘুষখোর এহুদ ওলমার্ট প্রধানমন্ত্রী হয়েই ইজ়রায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর আক্রমণ কৌশলে বদল ঘটান। প্রত্যক্ষ আক্রমণে গাজ়া উপত্যকায় সাধারণ আরবি নাগরিকদের মেরে ফেলা শুরু হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের গুলি করে মারা হয়। গাজ়ার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মোহভঙ্গতা তখন স্পষ্ট। কিন্তু কোন দল, ফাতাহ না হামাস, কে যে তাদের পছন্দের, সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও থাকে কুয়াশাছন্ন।
২০০৭র জুনের পর গাজ়া উপত্যকায় হামাসের ব্যাপক ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। ওলমার্ট বাহিনীর সামরিক কৌশলী প্রচারে সামনে আসে ইজ়রায়েল প্রতিরক্ষার প্রশ্ন। পরিচিতিসত্তার রাজনীতি পিছনে চলে যায়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে সন্ত্রাসী হামাস নির্মূলকরণে নামে ইজ়রায়েল। মাত্র ২২ দিনে গাজ়ায় সহস্র নিরস্ত্র আরবভাষীর মৃত্যু কোনো অলৌকিক ক্ষমতাতেই রুখে দেওয়া সম্ভব হয় না।
বৃহত্তর সিরিয়ান সেনাবাহিনীর উপর ম্যাকাবিদের বিজয় উদযাপন-ঐতিহ্যে পালিত ইহুদি দীপাবলির হানুক্কা উৎসবের শেষে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, সেই গণহত্যা সংগঠিত হয়। ইতিহাসে সেই অমানবিক ঘটনা অপারেশন ‘কাস্ট লিড’ নামে কুখ্যাত। এই ঘটনা হামাসকে আরও সংগঠিত ও কৌশলী করে তোলে। যখন জ়ায়নবাদ নিজেকে ইহুদি-বিদ্বেষের সমাধান হিসেবে মূর্ত করে।
২০০৯ থেকে এই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় হিংসা চূড়ান্ত অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছায়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীকে ইজ়রায়েলের জাতীয়তাবাদী (জ়ায়নবাদী) রাজনীতিতে সফলতা আনতে ব্যবহার করা শুরু হয়। দ্বিতীয় নেতানিয়াহু সরকার সেটা পরিকল্পিতভাবে কার্যকরী করে। জন্মসূত্রে ইহুদি হয়েও ধর্মনিরপেক্ষ ইজ়রায়েলবাসী, আরবিভাষী ইহুদি এবং ইজ়রায়েলের কমিউনিস্ট পার্টি সহ বহু শান্তিকামী সংগঠন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করেন।
ইজ়রায়েল জুড়ে সামাজিক প্রতিবাদে তাঁবু আন্দোলন সংগঠিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় নেতানিয়াহু সরকারের (২০০৯-১৩) তাতে কিছু যায় আসে না। ২০১৩র নির্বাচনের আগে ইজ়রায়েলে চার নাগরিক ও দুই সেনা মৃত্যুর ঘটনাকে হাতিয়ার করে শুরু হয় অপারেশন ‘মেঘের স্তম্ভ’। অলক্ষ্য ইজ়রায়েলি হানাদারিতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়া উপত্যকায় মৃত্যুর মিছিল সংগঠিত করার কাজটি সহজভাবে সম্ভবপর হয়। ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘বিবি’ দুর্নামে পরিচিত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সাধারণ ফিলিস্তিনিদের শুধুমাত্র সন্ত্রাসী সন্দেহেই মেরে ফেলার আদেশ দেন। তাতে তিনি সহজেই ২০১৩র নির্বাচন উৎরিয়ে যান।
২০১৫র নির্বাচনের আগে সেটা আর অতিকথন থাকে না। সহিষ্ণুতা লৌকিকতা হারায়। ২০১৪র জুলাই মাসের প্রথমে ‘প্রতিরক্ষামূলক প্রান্ত’ নামে আর এক সামরিক অপারেশন গাজ়ায় শুরু হয়। আগস্ট মাস জুড়ে সেটাকে চালু রাখা হয়। প্রায় ৫০ দিন ধরে চলা সেই আক্রমণে নেতানিয়াহু হিংসার মাত্রাকে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভাসিয়ে দেন। প্রতিরক্ষার নামে নেতানিয়াহু সরকার পরিচয় রাজনীতির ষড়যন্ত্রী লালায় ক্ষমতাকে জড়িয়ে নেন।
বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকায় যেমন অ্যান্টিফা, ফিলিস্তিনে তেমন ধর্মবাদী হামাস প্রতিরোধের নামে হিংসাকে জাগিয়ে রাখে। জ়ায়নবাদী চেতনায় ঠিক তেমন অবস্থানই নেয় জাতিতন্ত্রী ইজ়রায়েল। গণনিধনের সেই সংগঠিত অন্ধকারে জাতিসংঘ শুধু হিংসাকে সংখ্যায় প্রকাশ করে। ইজ়রায়েলের অলৌকিক সামরিক ক্ষমতায় প্রায় ১৭,০০০ বাড়ি পুরোপুরি এবং ৩০,০০০ টি আংশিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই হিংস্র মত্ততায় ৫৫১ জন শিশু এবং ২২৯ জন মহিলা সহ ১৪৯২ জন সাধারণ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হন। ৩,৩৭৪ জন শিশু অস্ত্রহানার জাদুবলে একপলকে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, যাদের মধ্যে ১,০০০ জনের বেশি স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। পাল্টা আক্রমণে হামাস ৬৬ জন ইজ়রায়েলি সৈন্য, একজন শিশু সহ পাঁচজন ইজ়রায়েলি নাগরিক এবং একজন থাই নাগরিককে হত্যা করে। ৪৬৯ আইডিএফ সৈন্য এবং ২৬১ জন ইজ়রায়েলি নাগরিক আহত হন।
জাতীয় সুরক্ষার আবেগে সেনা মৃত্যুর ঘটনা রাজনীতির পাশবিক খেলায় নেতানিয়াহুর বিজয়কে নিশ্চিত করে। চতুর্থ (২০১৫-১৯), পঞ্চম (২০১৯-২০), ষষ্ঠ (২০২০-২১) ও সপ্তম (২০২২ থেকে আজও) নেতানিয়াহু সরকার চালাতে বিবির কাছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজ়া উপত্যকা হয়ে ওঠে তুরুপের তাস। ষষ্ঠ ও সপ্তম নেতানিয়াহু সরকারের মাঝের সময়টিতে, ২০২১-২০২২ সাল, দুটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রতিরক্ষার নামে পরিচয় রাজনীতির ষড়যন্ত্রী লালায় তারা অল্প সময় টিকে থাকতে পারে।
২০২৩ সালে গোটা বিশ্বে দেড় কোটির একটু বেশী ইহুদি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি এখন ইজ়রায়েলে নেতানিয়াহু সরকারের সুরক্ষিত ছায়ায় বসবাস করেন। ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’ ধারণায় তারা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন। ফিলিস্তিনে ১০০ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তারা যে-কোনো কথোপকথনকে এড়িয়ে চলেন। আর তাতেই বর্বরতা আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক গড়নে মানব-জীবনকে অনিশ্চয়তায় ভরিয়ে তোলে।
ফিলিস্তিনি নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে তাই আজ স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক জীবনের অধিকার হয় লুণ্ঠিত। বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অনিবার্য পরিণতিতেই সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় গড়াগড়ি খায়। হামাস সন্ত্রাসী পরিচয় প্যালেস্টিনীয় বা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উপর ইজ়রায়েলি সামরিক শাসন আরোপ করাকে বৈধতা দেয়। ঠিক তখনই সাম্রাজ্যবাদের অলৌকিক অবয়বে প্রতিরক্ষার নামে পরিচয় রাজনীতির ষড়যন্ত্রে জারিত হয় একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতি।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন