ত্রিপুরার পুর নির্বাচন সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। লাগামছাড়া সন্ত্রাস ও কারচুপির অভিযোগ ছিল প্রথম থেকেই। এমনকি নজিরবিহীনভাবে ভোটের দিন সুপ্রিম কোর্ট অতিরিক্ত নিরাপত্তাবাহিনী নামাতে নির্দেশ দিয়েছিল। তাতেও অবশ্য বিশেষ লাভ হয়নি। বিরোধী ভোটারদের বাড়িতে বাড়িতে হুমকি, ভোট দিতে বাধা দেওয়া কিংবা ছাপ্পা চলেছে অবাধে। এই অভিযোগ উঠেছে সমস্ত বিরোধীদের পক্ষ থেকেই।
এবারের পুর নির্বাচনে প্রায় ৯৮.৫ শতাংশ আসন জিতেছে বিজেপি। অবশ্য এই ফলাফলকে বিজেপির বিরাট সাফল্য হিসাবে দেখাতে মরিয়া একাংশ। যারা ভোট পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সন্ত্রাস অথবা রিগিং প্রসঙ্গে একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। আবার অন্য এক অংশ তৃণমূলকে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। কিন্তু বাস্তবতা কী? আদৌ কী তৃণমূল ত্রিপুরায় প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উঠে এসেছে? বিজেপি ঘনিষ্ঠ মহল থেকে তৃণমূলকেই বা প্রধান বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হচ্ছে কেন? এতে কী বিজেপির কোনও সুবিধা হবে?
সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিজেপি ৩৩৪টি পৌর আসনের মধ্যে ৩২৯টি আসন জিতেছে, অর্থাৎ সমস্ত আসনের ৯৮.৫ শতাংশ। যার ফলে ২০টি পৌরসভার সবকটিতে জিতেছে। অন্যদিকে, ২০টি পৌরসভার মধ্যে ৭টি পৌরসভায় বিরোধীরা একটিও প্রার্থী দিতে পারেনি। মোট ৩৩৪ টি আসনের মধ্যে ১১২ টি আসন বিজেপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। বিরোধীদের অভিযোগ তাঁদের মনোনয়ন জমা দিতেই দেওয়া হয়নি।
অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচনই হয়নি। যেসব আসনে নির্বাচন হয়েছে সেখানে ভোটারদের ভয় দেখানো ও বুথ দখলের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ, ভোটের আগের দিন বহিরাগতরা এলাকায় প্রবেশ করে বাম সমর্থকদের ‘ভোট দিতে গেলে ভয়ানক পরিণতি হবে’ বলে হুমকি দিয়েছে। নির্বাচনের দিন অনেক বুথ দখল করা হয়েছে, পোলিং এজেন্ট এবং কিছু ক্ষেত্রে রিপোর্টিং অফিসারদেরও ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক ওয়ার্ডে প্রার্থীরাও নিজেদের ভোট দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ।
এবার আসা যাক তৃণমূলের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসার বাস্তবতায়। যে সমস্ত আসনে নির্বাচন হয়েছে সেখানে বামপন্থীরা পেয়েছে ১৯.৬৫ শতাংশ। তৃণমূল ১৬.৩৯ শতাংশ। তৃণমূল মূলত, আগরতলা পুরসভার ফলাফলকে নিয়ে উৎসাহিত। সেখানে তারা মোট ওয়ার্ডের নিরিখে ভোট পেয়েছে ২০.১৪ শতাংশ ভোট। যেখানে বামেরা পেয়েছে ১৭.৯৪ শতাংশ ভোট। কিন্তু এমন হওয়ার পিছনেও যথেষ্ট কারণ আছে। বামেরা আগরতলা পুরসভার সব ওয়ার্ডে নির্বাচন লড়েনি। বলা বাহুল্য মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি অথবা প্রার্থীরা ক্রমাগত হুমকির জেরে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু তৃণমূলের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তারা বামেদের না লড়া ওয়ার্ডে লড়েছে। যেখানে বামেরা লড়েনি, মূলত সেই ওয়ার্ডের বাম ভোটারদের ভোটের একাংশ তৃণমূলের ঝুলিতে গেছে। সিপিআইএম নির্বাচনের দিন তার পোলিং এজেন্টদের প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এমনকি, গণনার দিনে এজেন্টদেরকেও গননাকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এরপরেও সিপিআইএম যে যে ওয়ার্ডে লড়েছে, সেই নিরিখে ভোট পেয়েছে ১৯.৭৬ শতাংশ ভোট।
আগরতলার বাইরে তৃণমূলের হাল তথৈবচ। ৭.৭৮ ভোট পেয়েছে তারা। আগরতলার বাইরে বামদের ভোটের হার ২৩.৫৫ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনে বামেরা ভোট পেয়েছিল ১৭.৩১%। তাই, বাম কর্মী, প্রার্থী এবং সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসা সত্ত্বেও, বামরা তাদের ভোটের হার সামান্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট ছিল ২৫.৩৪% যা এখন ২.৭% -এ নেমে এসেছে। সুতরাং, কংগ্রেস ভোটারদের একটি বড় অংশ তৃণমূলে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে এবং এটি বিশেষ করে আগরতলায়।
সর্বোপরি, মোট ভোটের শতাংশেও তৃণমূল কোনোভাবেই বিরোধীদলের জায়গা দখল করতে পারেনি। আগরতলায় একটু নজর কাড়লেও আগরতলার বাইরে ভোটের শতাংশ দুই অঙ্ক পার হয়নি।
তৃণমূল কোনোরকম সংগঠন ছাড়াই ভোটের ৩ মাস আগে ত্রিপুরাতে হাজির হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্যই ছিল কংগ্রেসের সংগঠন ভেঙে তাদের দিকে নেতা টানা। সেই উদ্দেশ্যে বেশকিছুটা সফল তারা। একাধিক কংগ্রেস নেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সাথে ছিল প্রশান্ত কিশোর বাহিনীর বিপুল অর্থ ও মিডিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক এটাই চাইছে বিজেপি। বিরোধী ভোট যত ভাগ হবে, তাতে লাভবান হবে তারা। তাই তারাও বিভিন্নভাবে তৃণমূলকে প্রাসঙ্গিক করতে চেয়েছে। কংগ্রেসের একটা বড় অংশের ভোটার তৃণমূলের ঝকঝকে উপস্থিতি ও টলিউড অভিনেতাদের প্রচারে প্রভাবিত হয়েছেন বলে ধারণা করা যায়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন