২০১১ সালে যখন বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাধীনতার সময় থেকে সেইসময় পর্যন্ত রাজ্যের পুঞ্জীভূত ঋণ ছিল ১.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র ১১ বছরেই সেই পুঞ্জীভূত ঋণ আকাশ ছুঁয়েছে। রাজ্য সরকারের বাজেটের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০-২১ আর্থিক বছরের শেষ নাগাদ পুঞ্জীভূত ঋণ ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত যেতে পারে। রাজ্যের আর্থিক অবস্থা এতটাই ভয়ংকর যে, জানুয়ারি মাসেই খোলা বাজার থেকে রাজ্যকে তিনবার ঋণ নিতে হয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার জারি করা বিবৃতি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গ ২১শে জানুয়ারী খোলা বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। যা এই মাসে তৃতীয় বার। জানুয়ারিতে রাজ্যের মোট ঋণ ৬,৫০০ কোটিতে পৌঁছেছে। বাজার থেকে এত বড় অঙ্কের ধারের ক্ষেত্রে যা উত্তরপ্রদেশের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজ্য। এর আগে রাজ্য জানুয়ারিতে দুই কিস্তিতে ৩,৫০০ কোটি টাকা ধার করেছিল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার জারি করা বিবৃতি অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গ ২১শে জানুয়ারী খোলা বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। যা এই মাসে তৃতীয় বার। জানুয়ারিতে রাজ্যের মোট ঋণ ৬,৫০০ কোটিতে পৌঁছেছে।
এর আগে ডিসেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুবার খোলা বাজার থেকে ঋণ নিয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর, সাতটি রাজ্য বাজার থেকে মোট ৫,০৫৩ কোটি টাকা ধার করেছে। এই সাতটি রাজ্যের মধ্যে সব থেকে বেশি ধার নেয় পশ্চিমবঙ্গ। ২,৫০০ কোটি টাকা। ওই মাসেরই ২৪ তারিখে, মোট ১৬টি রাজ্য বাজার থেকে মোট ২২,৯৮৪ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের ঋণ ছিল সর্বোচ্চ ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারী এই ৪১ দিনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার খোলা বাজার থেকে মোট ১৩,০০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে।
এপ্রিল ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২০-এর মধ্যে যখন মহামারী পরিস্থিতি এবং লকডাউনের কারণে রাজ্যের রাজস্ব সর্বকালের সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল, তখন রাজ্য বাজার থেকে প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকা ধার করেছিলো। অদ্ভুত ভাবে চলতি আর্থিক বছরে এপ্রিল ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বাজার থেকে ধার নিয়েছে ৫২,৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে একই সময়ে রাজ্য উন্নয়ন ঋণের মাধ্যমে ২৮,০০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছিল।
এপ্রিল ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২০-এর মধ্যে রাজ্য বাজার থেকে প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকা ধার করেছিলো। চলতি আর্থিক বছরে এপ্রিল ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বাজার থেকে ধার নিয়েছে ৫২,৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে একই সময়ে রাজ্য উন্নয়ন ঋণের মাধ্যমে ২৮,০০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছিল।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্ত বিভাগকে অনুমোদিত বাজেটের বাইরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে এবং মুখ্য সচিব বা অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোনও নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। যে ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সরকার নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রীর ডোল পলিটিক্সের অ-পরিকল্পিত ব্যয়ের মাধ্যমে চাপানো আর্থিক বোঝার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, "কেন্দ্রর কাছে রাজ্যের ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা। তা সত্ত্বেও, রাজ্যের অর্থ বিভাগ এই বছর বিভিন্ন বিভাগে ৭৪ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে এবং এই তহবিলের ৮৪ শতাংশ ইতিমধ্যেই ব্যয় করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বাজেটে অনুমোদিত নয় এমন কোনও প্রকল্প করা উচিত নয়। যে কোনও প্রকল্পের জন্য মুখ্য সচিব এবং অর্থ বিভাগের বাধ্যতামূলক অনুমোদন নিতে হবে।"
তিনি আরও জানিয়েছেন, রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহ গত দু’বছর ধরে কোভিড মহামারীর জন্য কমেছে। তিনি বলেন, মালদা বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জমি কেনার প্রস্তাবের জন্য রাজ্য সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে পারবে না। "আমি ১০০ কোটি টাকা (জমি হারাদের) দিতে পারবো না। আমি তাদের জন্য বাড়ি তৈরি করতে পারি, চাকরি দিতে পারি কিন্তু আমি তাদের জমি কিনতে পারবো না। সরকারের কাছে অত টাকা নেই।”
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের রাজস্ব বাড়াতে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, রাজস্ব বাড়ানোর জন্য রাজ্য পরিবহন বিভাগ সীমান্তে কাজ করা সমস্ত ট্রাক টার্মিনালগুলিকে অধিগ্রহণ করবে।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, কিছু লোক কিছু আধিকারিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সীমান্তে ট্রাক টার্মিনাল থেকে টাকা নিচ্ছে। ৭ ফেব্রুয়ারির আগে সব ট্রাক টার্মিনালের দখল নেওয়ার কাজ শেষ হবে।
রাজ্য সরকারের অ-পরিকল্পিত ব্যয়ের বিশাল খরচ মেটানোর প্রচেষ্টা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন মহামারী এবং রাজ্যের পরিকল্পিত এবং অ-পরিকল্পিত ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারে এমন একটি সঠিক রাজস্ব মডেল তৈরি করতে ব্যর্থতার কারণে রাজ্যের রাজস্ব কমেছে।
এর আগে আইএএনএস জানিয়েছিলো, রাজ্য সরকার যদি নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত স্বাস্থ্য সাথী বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো সামাজিক প্রকল্পগুলি চালানোর কথা ভাবে সেক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের জন্য বাজারের ঋণই একমাত্র কার্যকর বিকল্প হতে পারে। কারণটা খুবই সহজ।
তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি বড় প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন - 'লক্ষ্মীর ভান্ডার' এবং ‘স্বাস্থ্য সাথী' সবার জন্য। যে দুই প্রকল্পে বিশাল টাকার প্রয়োজন। 'লক্ষ্মীর ভান্ডার’ একটি প্রকল্প যেখানে রাজ্য এসসি/এসটি/ওবিসি মহিলাদের জন্য ১০০০ টাকা এবং সাধারণ বর্ণের মহিলাদের ৫০০ টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। যারা এখনও পর্যন্ত এই স্কিমে নাম নথিভুক্ত করেছেন সেই সংখ্যা প্রায় ১.৮ কোটি। সরকার এখনও পর্যন্ত এঁদের জন্য ১২,৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
প্রাথমিকভাবে সরকারের অনুমান ছিল যে প্রায় ২ কোটি সুবিধাভোগী 'লক্ষ্মীর ভান্ডার' প্রকল্পের জন্য নিবন্ধন করবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত, সরকার ১.৬৩ কোটি আবেদন পেয়েছে। যার মধ্যে ১.৫২ কোটি অনুমোদিত হয়েছে। প্রায় ৭ লাখ আবেদন খারিজ হয়েছে। সরকার এই প্রকল্পে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে এবং অর্থ বিভাগ অনুমান করেছে যে রাজ্য সরকারকে আরও ৫,৬০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। যা পুরো আর্থিক বছরে একটি ভয়ংকর পরিসংখ্যানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত-এর পাল্টা রাজ্য তার নিজস্ব স্কিম চালু করেছে – ‘স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প'। যেখানে রাজ্যের কিছু নাগরিককে পাঁচ লক্ষ টাকার বার্ষিক স্বাস্থ্য কভারেজ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সমস্ত নাগরিকদের জন্য ‘স্বাস্থ্য সাথী' চালু করেছেন, যা ব্যয়ের পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি এক বছর আগেও এই প্রকল্পের আনুমানিক বাজেট ছিল প্রায় ৯২৫ কোটি টাকা, কিন্তু এই বছর বরাদ্দ বার্ষিক ২,০০০ কোটি টাকা স্পর্শ করেছে৷
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতির সময় রাজ্য সরকারের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে বাজার থেকে একের পর এক ঋণ নিতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গকে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুসারে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী প্রচারের সময় যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেইসব পরিকল্পনা বহির্ভূত ব্যয় পূরণ করতে বেশিরভাগ খরচ হচ্ছে।
- with inputs from IANS
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন