উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার চলার সময়, মেটা-মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা স্বয়ংক্রিয় বাল্ক মেসেজিং রুট-এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ভোটারকে আকৃষ্ট করার জন্য ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি সেল ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং ব্রডকাস্ট লিস্ট তৈরি করেছে এবং ১০-১২ কোটিরও বেশি ভোটারের স্মার্টফোনে বিশেষ রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তা ব্যবহার করা হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশের ভোটার তালিকা অনুসারে রাজ্য ১৫.০২ কোটি রেজিস্ট্রিকৃত ভোটার। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০-১২ কোটির কাছে স্মার্টফোন আছে এবং তাতে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করা আছে। ইন্টারনেটে ভয়েস কলিং সহ WhatsApp, KaiOS-ভিত্তিক স্মার্ট ফিচার ফোনও ব্যবহারকারীদের কাছে আছে।
উত্তরপ্রদেশের ভোটার তালিকা অনুসারে রাজ্য ১৫.০২ কোটি রেজিস্ট্রিকৃত ভোটার। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০-১২ কোটির কাছে স্মার্টফোন আছে
দেশের অন্যতম শীর্ষ সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অনুপ মিশ্রের মতে, বাল্ক হোয়াটসঅ্যাপ API (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস) সরঞ্জামের মাধ্যমে, দল এবং প্রার্থীরা এখন নতুন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং সম্প্রচার তালিকা তৈরির ঝামেলা এড়ায়।
অনুপ মিশ্র আইএএনএসকে জানিয়েছেন, "বিভিন্ন সংস্থা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে মেসেজ প্রতি মাত্র ৮ থেকে ১০ পয়সা খরচ করে ভোটারদের হোয়াটসঅ্যাপে সরাসরি রাজনৈতিক বার্তা পাঠাচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ।" তিনি বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অফার করা এরকম বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক বাল্ক মেসেজের স্ক্রিনশটও দিয়েছেন।
ভোটের মুখে বাল্ক মেসেজ পাঠানোর জন্য বিভিন্ন অফার চলছে। 'চুনাভি ডিজিটাল প্রচার ২০২২' (বা নির্বাচনী ডিজিটাল প্রচার ২০২২) নামে অফারগুলি হল: "বাল্ক এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ মার্কেটিং, ভয়েস কল, বাল্ক মেসেজের মাধ্যমে ভোটারদের আপনার পক্ষে আনুন" এবং "আপনি আপনার ভোটারদের মেসেজ, ছবি, এবং হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস ক্লিপ, ভিডিও পাঠাতে পারেন।" এর সঙ্গেই ভোটারদের ডেটাবেস দেওয়া হবে বলেও জানানো হচ্ছে।
কোনো কোনো সংস্থা নিজেদের ভারতের ১ নম্বর নির্বাচনী প্রচার প্রদানকারী বলে দাবি করে, পিন কোড এবং বিধানসভা-ভিত্তিক তথ্যভান্ডার দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এইসব সংস্থা "বাল্ক হোয়াটসঅ্যাপ, বাল্ক ভয়েস কল এবং API এসএমএস" করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানাচ্ছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি 'মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট'-এর মাধ্যমে শারীরিক সভা/মিছিল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করাতে ব্যস্ত থাকার সময় ব্যাপকহারে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভোটারদের কাছে গণহারে মেসেজিং চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিরাগ গুপ্ত আইএএনএসকে জানিয়েছেন, "হোয়াটসঅ্যাপ এই ধরনের অননুমোদিত বাল্ক মেসেজিংয়ে একটি বড় সুবিধাভোগী। যদিও বর্তমানে নির্বাচন কমিশন প্রচলিত প্রচার ব্যবস্থায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এই ধরনের অননুমোদিত পদ্ধতিতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অধীনে একটি অপরাধ।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিরাগ গুপ্ত আইএএনএসকে জানিয়েছেন, "হোয়াটসঅ্যাপ এই ধরনের অননুমোদিত বাল্ক মেসেজিংয়ে একটি বড় সুবিধাভোগী। এই ধরনের অননুমোদিত পদ্ধতিতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অধীনে একটি অপরাধ।"
এই প্রসঙ্গে আইএএনএস-এর পক্ষ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ ইন্ডিয়াকে প্রশ্নাবলী পাঠানো হলেও এখনও তার উত্তর পাওয়া যায়নি।
২০১৯ সালে, বেশ কয়েকটি মব-লিঞ্চিং-এর ঘটনা দেশকে নাড়া দিয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে শিশু চুরির গুজব ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৩০ জনেরও বেশি লোক গণপিটুনিতে নিহত বা আহত হয়েছে।
এমনকি সুপ্রিম কোর্ট মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওইসময় হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাপটির অননুমোদিত ব্যবহারের বিষয়ে তার নীতি আপডেট করে বাল্ক মেসেজিং সীমাবদ্ধ করে নিয়ম আনতে বাধ্য হয়েছিল।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সংস্থা জানায়, যারা বাল্ক মেসেজ বা স্বয়ংক্রিয় বার্তা পাঠিয়ে প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারে জড়িত আছে বা অন্যদের সহায়তা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যদিও, এই ধরনের স্বয়ংক্রিয় বাল্ক মেসেজ আবার কার্যকর হয়েছে। এই জাতীয় বাল্ক মেসেজ পাঠিয়ে যারা এই শর্তাবলী লঙ্ঘন করছেন সেরকম কোনো ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ করে "পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে বড় আকারে এইসব নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিরাগ গুপ্তা আরও জানিয়েছেন, "রাজনৈতিক দল এবং বিপণন সংস্থাগুলি এই নিয়মটি লঙ্ঘন করার জন্য বট, অটোমেশন স্ক্রিপ্ট, অ্যালগরিদম এবং সময়ের ব্যবধান ব্যবহার করছে," গুপ্তা বলেছেন৷
মিশ্রের মতে, রাজনৈতিক দলগুলি জানে যে তারা নির্বাচনের সময় জনসাধারণের কাছে যত বেশি ভুয়ো এবং বিভ্রান্তিকর সামগ্রী পাঠাবে, এটি তত বেশি ভাইরাল হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, "ভুয়ো বিষয়বস্তু যত বেশি ভাইরাল হবে, তত বেশি এটি তার উদ্দেশ্য পূরণ করবে। বেশিরভাগ মানুষ এই ধরণের মেসেজ ফরওয়ার্ড করার সময় বিষয়বস্তুর সত্যতা যাচাই করে না।"
মিশ্র জানিয়েছেন, "ভুয়ো বিষয়বস্তু যত বেশি ভাইরাল হবে, তত বেশি এটি তার উদ্দেশ্য পূরণ করবে। বেশিরভাগ মানুষ এই ধরণের মেসেজ ফরওয়ার্ড করার সময় বিষয়বস্তুর সত্যতা যাচাই করে না।"
পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া এবং মণিপুরের বিধানসভা নির্বাচন সাতটি ধাপে সম্পন্ন হবে এবং উত্তরপ্রদেশে প্রথম ১০ ফেব্রুয়ারি ভোট নেওয়া হবে। ১০ মার্চ পাঁচ রাজ্যের ভোট গণনা করা হবে।
সম্প্রতি, মাদ্রাজ হাইকোর্ট জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলিকেও ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
"এই প্রেক্ষাপটে, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই প্রার্থী, দল এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে আইন ও নিয়মের এই ধরনের পদ্ধতিগত এবং বড় আকারের লঙ্ঘনের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ" বলে দাবি করেছেন বিরাগ গুপ্তা।
তিনি আরও বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রণীত নিয়মগুলির সংগঠিত লঙ্ঘনের জন্য হোয়াটসঅ্যাপের বিরুদ্ধে অবমাননার মামলাও শুরু করা যেতে পারে।"
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন